জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী একটি গুরুতর সমস্যা, এবং বাংলাদেশ এ সমস্যার শিকার দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশকে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, লবণাক্ততা বৃদ্ধি ইত্যাদি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাব হিসেবে দেখা যাচ্ছে। এই প্রভাব দেশের অর্থনীতি, কৃষি, স্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এই সংকট মোকাবিলায় ব্যক্তিগত ও জাতীয় পর্যায়ে উদ্যোগ নিতে হবে। বৈশ্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে টেকসই পরিবেশ ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান প্রভাব
১. সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও উপকূলীয় এলাকা
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে, যার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ একটি নিম্নাঞ্চলীয় দেশ হওয়ায় এ পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কৃষিজমি ও সুপেয় পানির উৎস নষ্ট হচ্ছে এবং বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে।২. ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের বৃদ্ধি
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ও তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৭ সালের সিডর, ২০০৯ সালের আইলা এবং সাম্প্রতিক আম্পান ও বুলবুল প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর ভয়াবহতা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এসব দুর্যোগ ফসলের ক্ষতি করে, ঘরবাড়ি ধ্বংস করে এবং জনজীবন বিপর্যস্ত করে।৩. কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার হুমকি
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অসময়ে অতিবৃষ্টি, খরা ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি কৃষির জন্য বিরূপ প্রভাব ফেলছে। ধান, গম, আলু, পাটসহ বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন কমে যাচ্ছে, যা খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে।৪. বন্যা ও নদী ভাঙন
বাংলাদেশের নদীগুলো বর্ষাকালে প্রচণ্ড বন্যার সৃষ্টি করে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অতিবৃষ্টি ও হিমালয়ের বরফ গলার হার বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে নদীভাঙন ও বন্যা হচ্ছে। এতে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ছে।৫. জনস্বাস্থ্য সংকট
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানিবাহিত রোগ যেমন- ডায়রিয়া, টাইফয়েড, কিডনি সমস্যা এবং চর্মরোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অতিরিক্ত গরমের কারণে হিটস্ট্রোকের ঘটনা বাড়ছে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে।৬. জীববৈচিত্র্যের উপর প্রভাব
সুন্দরবনের মতো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী বনাঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে। লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে গাছপালা ও প্রাণীর জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বিভিন্ন বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্তির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।সমাধান ও করণীয়
জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। তবে আরও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি—- বনায়ন বৃদ্ধি: অধিক পরিমাণে গাছ লাগানো এবং বনাঞ্চল সংরক্ষণ করা।
- কৃষিতে টেকসই প্রযুক্তির ব্যবহার: লবণসহনশীল ফসল উৎপাদন ও খরা সহনশীল কৃষি প্রযুক্তির প্রসার।
- পরিবেশবান্ধব জ্বালানির ব্যবহার: নবায়নযোগ্য শক্তির (সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎ) প্রচলন বাড়ানো।
- নদী ও উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ: নদীভাঙন রোধে কার্যকর বাঁধ নির্মাণ ও উপকূলীয় এলাকায় টেকসই অবকাঠামো তৈরি করা।
- সচেতনতা বৃদ্ধি: সাধারণ জনগণের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এই সংকট মোকাবিলায় ব্যক্তিগত ও জাতীয় পর্যায়ে উদ্যোগ নিতে হবে। বৈশ্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে টেকসই পরিবেশ ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব।