২০১২ সালের কোনো এক সময়। হুট করেই মাথায় এল সুন্দরবন ভ্রমণের চিন্তা। গুগল ইমেজ ঘেঁটে কিছু ছবি দেখে আগ্রহ আরও বেড়ে গেল। ইন্টারনেট তখন ছিল ২G, গুগল ম্যাপও তেমন কার্যকর ছিল না, তাই ট্রিপ প্ল্যানিং করতে হয়েছিল পুরোটাই অভিজ্ঞতা আর অনুমানের ওপর নির্ভর করে।
দুপুরে গোসল করে লাঞ্চ করে নিলাম। এবার ব্যাকপ্যাক গুছানোর পালা। কয়েটা শার্ট প্যান্ট, তোয়ালে, পারফিউম, মোবাইল চার্জার, আমার নোট খাতা, ম্যাপ, টুথব্রাশ ইত্যাদি ব্যাগ এ ঢুকিয়ে নিলাম। ব্যাগ গুছিয়ে মোফাজ্জেলের মেসে গেলাম। ওর কাছ থেকে ওর নকিয়া ৬৬০০ মোবাইলটা নিলাম, কারণ ওর মোবাইলের ক্যামেরায় ভালো ছবি উঠত। তারপর ছুটলাম কুমিল্লা রেলস্টেশনের দিকে।
আরও: কাপ্তাই লেক: প্রকৃতির কোলে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা
কুমিল্লা রেলওয়ে স্টেশন এ এসে ঢাকার জন্য এটা টিকেট কাটতে গেলাম। আমকে বলল ট্রেন এর টিকিট নাকি শেষ! এরপর রাত ৮টার দিকে যেটা আসবে সেটার টিকেট কাটার জন্য বলছে। কিন্তু কথা হল, আমি তো এখান থেকে ঢাকায় পৌছে আবার রাতের ট্রেনেই খুলনা যাবো। এখন যদি এখান থেকে ই রাতের ট্রেনে যাই তাহলে ঢাকায় পৌছাতে পৌছাতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। আর আমার খুলনার ট্রেন টা ও মিস হয়ে যাবে।
টিকেট কাউন্টারে বললাম, এই ট্রেনে যাওয়ার কি কোন উপায় আছে? আমাকে তারা বলল, আপনি চাইলে দাড়িয়ে যেতে পারেন তবে সেক্ষেত্রে ও কিন্তু আপনাকে টিকেট কাটতে হবে এবং সম্পুর্ন টিকিটের টাকা দিতে হবে। কি আর করা… খুলনার ট্রেনের কথা ভেবে টিকিট কেটে নিলাম। সময় তখন বিকাল ৪ টা এর মত বাজে। প্রায় দের ঘন্টা অপেক্ষা করার পর ট্রেন আসল কিন্তু একি, ট্রেনে যে মানুষ আর মানুষ! এতো মানুষ, যে ট্রেন ই ঠিক মত দেখা যাচ্ছে না! বহু কষ্টে ট্রেনে উঠলাম ঠিক কিন্তু বসার তো দুরের কথা দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়া ই ভার।
যাইহোক কোন রকম ভাবে একপাশে দাড়াতে পারলাম তাও অনেক ঠেলে ঠুলে। ট্রেন চলতে লাগল। একের পর এক স্টেশন এ দাঁড়াচ্ছে আর লোকজন উঠছে হু হু করে। তখন কি যে বিরক্ত লাগছিল নিজের কাছে। আরো বেশি বিরক্ত আর টেনশন হচ্ছিল ট্রেন চলার গতি দেখে। যাকে কচ্ছপ গতি বলে। আমাদের ট্রেন যখন ঢাকার কাছাকাছি তখন, এক ভদ্রলোক আমাকে তার সীট এর হাতলে বসার সুযোগ করে দিলেন। কাধে ব্যাগ নিয়ে দাড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার পা অবশ হয়ে গিয়েছিল। হাতলে বসে দুনিয়ার সব সুখ খুজে পেলাম আমি। এভাবে ই ঢাকা কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন পৌছালো ট্রেন।
রাত ১২ঃ২৭!
ট্রেন থেকে বের হয়ে ই একটা পানির বোতল নিয়ে পানি খেলাম। তারপর সোজা চলে গেলাম টিকিট কাউন্টারে। খুলনার ট্রেন নাকি ইতিমধ্যে ই স্টেশন ছেড়ে চলে গিয়েছে! মনটাই খারাপ হয়েগেলো। একটা রিক্সা নিয়ে ছুটে গেলাম বাস স্টেশন এ। শুনেছি কপালে যেদিন খারাপ লেখা থাকে সেদিন নাকি, সবদিক দিয়ে ই খারাপ হয়। বাসের কাউন্টার গুলো বন্ধ। কয়েকজন কে জিজ্ঞের করে জানতে পারলাম। আজ রাতে খুলনার শেষ বাসটি ছেড়ে চলে গিয়েছে। আগামী কাল ছাড়া আর কোন বাস খুলনার উদ্দেশে ছেড়ে যাবে না।
বাধ্য হয়ে ফিরে আসলাম হোটেল এর খোঁজে। স্টেশন এর পাশে ই কিছু হোটেল পেলাম মোটামুটি মানের। ২ স্টার বলা যায়। একটা হোটেলের রিসিপসনে গিয়ে একরাতের জন্য একটি রুম ভারা নিলাম। ২য় তলায় আমার রুম । রুম এর চাবি নিয়ে ২য় তলায় উঠে আমার রুমে ঢুকলাম। যতটা খারাপ হবে ভেবেছিলাম রুম ততটা খারাপ না। রুমে এসি নেই ঠিক তবে, স্মার্ট টিভি থেকে শুরু করে সব কিছুই ছিল। একে তো ট্রেনে দাড়িয়ে এসেছি। তারউপর আবার ট্রেন মিস, বাস মিস! সব কিছু মিলিয়ে খুব ক্লান্তি বোধ করছিলাম। জামা কাপড় ছেড়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে গোসল করে নিলাম। ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে এসে ডিনার এর জন্য হোটেল থেকে বের হলাম। রাত তখন আনুমানিক ১ঃ৩৮ এর মত বাজে। খাবারের প্রায় হোটেল গুলো ই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অনেক খুঁজাখুঁজির পর একটা পেলাম। ডিনার শেষে রুমে ফিরে এসেই ফ্রেশ একটা ঘুম দিলাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ব্যাগ গুছিয়ে হোটেল থেকে বের হয়ে গেলাম। একটা রেস্টুরেন্ট এ ঢুকে সকালের নাস্তা করে নিলাম। তারপর সোজা গাবতলি বাস স্ট্যান্ড। গাবতলি আমার কাছে নতুন এক জায়গা। আগে কখনো আমি এখানে আসিনি। হানিফ পরিবহনে একটা টিকিট কাটলাম খুলনার জন্য। বাস ছাড়বে দুপুর ১ঃ৩০ মিনিটে। ঘড়িতে সময় বাজে তখন ১১ঃ ৫৫। কাউন্টারে বসে আছি। একটা ছোট্র ছেলে বসে আছে আমার পাশে। সময় কাটানোর জন্য ওর সাথে গল্প শুরু করলাম। ওর নাম রফিক। বাসা খুলনার কাছে কি যেন একটা জায়গার নাম বলল। আমার ঠিক মনে নেই। ওর বাবা ও আছে ওর সাথে। রফিক ৪র্থ শ্রেনিতে পড়ে। ছেলেটা বেশ ভালোই। আমাকে খুলনা সম্পর্কে অনেক কিছু জানালো। কথা চলতে থাকল ওর সাথে।
আমাদের বাস ছেড়েছে ১ঃ৪০ এর দিকে। জানালার পাশে আমার সিট। টিকিট কাটার সময়ই বলেছি যাতে আমাকে বাসের মাঝামাঝি এবং হাতের বা দিকে জানালার পাশে সিট দেয়। ওনি সেটা ই করেছেন। বাসে উঠার আগে অবশ্য দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়েছি। সাথে শুঁকন খাবার আর পানি নিয়েছি। এটা লং জার্নির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাসে উঠার আগে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে নেয়া জরুরি। এতে আপনার বাস ভ্রমন হবে আরাম দায়ক। না হলে ভিতর থেকে চাপ আসলে কেস্কি মারা ছাড়া উপায় থাকবে না। ভ্রমন হবে বিদঘুটে।
বাস চলছে। আমি কানে হেডফোন লাগিয়ে পুরন দিনের বাংলা এবং হিন্দি গান শুনছি। যে কোন জার্নিতে আমার পুরন দিনের গান অনেক ভালো লাগে। সময় টা কে অনেক উপভোগ্য করে তোলে। বাসের জানালা কাচের ভিতর দিয়ে বাহিরের দৃশ্য উপভোগ করছি। আর বাস চলছে শাঁ শাঁ করে। মাঝপথে একবার বিরতি দিয়ে আবার বাস চলতে থাকল। বিরতিতে সবাই ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নিল যারযার মত। আমিও করলাম।
রাত ১১ এর উপরে। আমার হাতের বা দিকে ষাট গম্বুজ মসজিদ রেখে বাস এগিয়ে চলল খুলনার সর্বশেষ বাস স্টেশন এ। রাতে বাস এর টিপ শেষে শহর থেকে দূরে এখানে এসেই বাসগুলো রাখা হয়। খুলনা শেষ বাস স্ট্যান্ড এ বাস পৌছাতে পৌছাতে বাস প্রায় খালি হয়ে গিয়েছে। রফিক ইতিমধ্যে তার বাবার হাত ধরে বাস থেকে নেমে পরেছে। সর্বশেষ বাস স্ট্যান্ডে এসে আমারা ছিলাম মাত্র ৪ জন। এর ভিতর বাস ড্রাইভার ১ জন, হেল্পার ১ জন আর আমরা বাস যাত্রী ২ জন। বাস কন্ট্রাক্টর আগেই নেমে পড়েছে। যাক অবশেষে আমি খুলনায় পৌছালাম।
---
বাস থেকে নেমেছিতো ঠিক কিন্তু একি…! এ আমি কোথায় আসলাম!! চারদিকে শুধু অন্ধকার। কোন লোকালয় নেই। জনমানব শূন্য। প্রথমে একটু ভরকে গিয়েছিলাম। পরক্ষনে ভালো করে তাকিয়ে দেখি অনেক দূরে একটা লাইট জ্বলছে। আলো লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলাম। এরকম রাত বিরাতে আমার চলতে তেমন ভয় লাগে না। এমনি একটা রাতে পৌছে ছিলাম খগড়াছড়ি তে। ওই খানে চারপাশে আলো ছিল। কারন ওটা ছিল একটা ছোট খাটো বাজার। কয়েকটা দোকান খোলা ছিল। কিন্তু কোন হোটেল দেখতে পাচ্ছিলাম না।
আমার রাতে থাকার জন্য একটা হোটেল দরকার ছিল। আশেপাশে কোথাও হটেল আছে কিনা সেটা জানার দরকার ছিল। কাউকে জিজ্ঞেস করতে যাব ভেবে একটা দোকানের দিকে যাওয়া শুরু করেছিলাম মাত্র। আমি থমকে দাড়িয়ে গেলাম। আমি একা। আমার সাথে টাকা পয়সা ছিল। মোবাইল ছিল। ছিল ল্যাপটপ ও। আরো অনেক কিছু। রাত তখন ১ টার উপরে বাজে। এতো রাতে একটা ছেলেকে পেয়ে তার কাছ থেকে সব কিছু নিয়ে নেয়া ব্যাপার না। তাছাড়া আমি তো কাউকে চিনিও না। কোন লোকটা ভালো?
এরকম পরিস্থিতিতে আমার স্টাডি বলেঃ প্রথমে দেখো কোন হোটেল আছে কিনা। হোটেল না পেলে দেখো কোন ডাক্তার এর চেম্বার বা দোকান খোলা আছে কিনা। কারন ডাক্তার ৯৫% ভালো লোক হয়। আমি তাদের পেশার কথা বলছি না কিন্তু! আমি ও তাদের কে মাঝে মাঝে সুযোগ পেলে কষাই বলে ডাকি। যদিও আমার পরিবারে আমার বাবা এবং মেঝো ভাই ডাক্তার। আলোর দিকে এসে দেখি একটা ছোট্র ভাতের দোকান, তার ভিতরে ২ জন লোক বসে আছে। একজন এর বয়স ৫০ এর উপরে হবে। সে টাকা গুনছে। দেখে মনে হল সারাদিন এর ইনকাম এর হিসাব করছে। আরেকজন পিচ্ছি ছেলে বসে আছে। বয়স ১০-১৫ এর মত হবে।
আমি কাছে যেয়ে বললাম। খাবার এর কি কিছু আছে? টাকা গুনতে গুনতে লোকটা বলল এই ওনাকে খাবার দে। আমাকে বলল, আপনি বসেন। পিচ্চি ছেলেটা বলল, কি দিব…? মাছ, মুরগি, ভর্তা, ডাল… কি দিব? হোটেল এর মুরগির উপর আমার ভরসা কম। তাই বললাম মাছ আর ডাল দাও। ভর্তা আমার ভালো লাগে না।
খেতে খেতে পিচ্চিকে জিজ্ঞেস করলাম এখানে থাকার হোটেল আছে? হ্যাঁ আছে তো। আমি খাওয়া বন্ধ করে ওকে জিজ্ঞেস করলাম কোথায়? কত দূর এখান থেকে। বেশি দূরে না… হাইটা ই জাইতে পারবেন। ওই যে দেখেন না লাইট টা জলতাছে। ওইটা ই হোটেল। আমি ঘড় ফিরিয়ে দেখলাম, আরে তাই তো । আমি তো খেয়াল ই করিনি। খাবার হোটেল থেকে খুব ভালো করেই দেখা যাচ্ছে লাইট এর আলো। আমি খাওয়া শেষ করে টাকা দিয়ে আবার আলোর পথে ছুটলাম।
৩ তলা বিশিষ্ট একটা আবাসিক হোটেল। হোটেল টা দেখে মন হল বেশিদিন হয় নি এটার বয়স। হোটেল এর সামনে গিয়ে দেখি, গেটে কোন দারওয়ান নেই। আমি গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। রিসিপসনে লাইট জ্বলছে। কিন্তু কেউ নেই! আমি কিছুক্ষন দাড়িয়ে থেকে তারপর সোফায় বসলাম। প্রায় ৭ মিনিট পর একজন মধ্যবয়স্ক লোক আসল। আমাকে দেখে বলল কোথা থেকে এসেছেন। ঢাকা থেকে। হোটেল এ থাকব ১ রাত।
লোকটি আমাকে হোটেল ভাড়ার একটা চার্ট দিলেন এবং কতদিন থাকব জিজ্ঞেস করলেন। সাথে আমাকে একটা ফর্ম দিলেন পুরন করার জন্য। আমি হোটেল এর টাকা দিয়ে রুম এর চাবি নিয়ে ২য় তলায় চলে আসলাম। আমার রুম এর সাথে একটা বারান্দা ও আছে। রুমে কোন টিভি নেই। বাথরুম এর ঝর্না নষ্ট। আরো কত হাবি যাবি। আমি কোন রকমে গোসল করে ঘুম দিলাম। মোবাইলে এলার্ম দিয়ে রাখলাম সকাল ৬টার। খুব ভোরে উঠতে হবে।
সকালে রিকশা ঠিক করলাম। প্রথম গন্তব্য খানজাহান আলীর মাজার। রিকশাওয়ালা সতর্ক করলেন, এখানে অনেক ভণ্ড লোক থাকে যারা নানা কৌশলে টাকা হাতিয়ে নেয়। মাজারের সামনে পৌঁছাতেই দেখলাম, উনি যা বলেছিলেন, তা-ই ঘটছে। অনেক দোকানদার মোমবাতি, আগরবাতি, গোলাপ জল ধরিয়ে দিতে চাইছে। আমি কোনো দিকে না তাকিয়ে মাজারের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। কিছু সময় সেখানে কাটিয়ে বেরিয়ে এলাম।
পরবর্তী গন্তব্য বাগেরহাটের ঐতিহাসিক ষাট গম্বুজ মসজিদ। মসজিদের প্রবেশদ্বারে টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকে বিস্মিত হলাম—অসাধারণ স্থাপত্য! প্রতিটি গম্বুজ যেন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মসজিদের পেছনে বিশাল দিঘী, তার পাড়ে গিয়ে কিছুক্ষণ বসলাম।
এরপর রিকশা করে বাসস্ট্যান্ডে ফিরে এলাম, এবার মংলার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। কারণ সেখান থেকেই শুরু হবে সুন্দরবনের আসল অভিযান!
বাস স্ট্যান্ড থেকে বাসে চড়ে চলে আসলাম মংলা। সময় লাগল প্রায় দের ঘন্টার মত। বাস থেকে নামতে যাবো। কয়েকজন এসে রীতিমত টানাটানি শুরু করে দিল। চলেন আমার ট্রলারে… আরেকজন বলছে চলেন আমার লঞ্চে। আমি পাশকাটিয়ে চলে আসলাম। প্রচন্ড রৌদ্র। আশেপাশে বেশ কিছু দোকানপাট রয়েছে। আমি দুপুরের লাঞ্চ সেরে নিলাম। লাঞ্চ করতে করতে যতটুকু বুজলাম এখানে আমার মত কেউ একা আসে না।
দলবল নিয়ে আসে। কেউ ফ্যামিলি নিয়ে আসছে, আবার কেউ বন্ধু বান্ধব নিয়ে আসছে। হইহুল্লোর করছে। আবার অনেকে গরমে ইংরেজি V এর মত পা ছড়িয়ে বসে আছে। আমি লাঞ্চ শেষ করে হাটতে হাটতে মংলা ঘাট এ চলে আসলাম। বাস থেকে যেখানে নেমেছি এটা তার থেকে বেশি দূরে নয়। আজকে আকাশ ভালো ই মনে হচ্ছে। বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। লোকজন আসছে আর ট্রলার, লঞ্চ এ করে সুন্দরবন এর উদ্দেশ্যে আনন্দ করতে করতে ছুটে যাচ্ছে। এখানে একটা আলাদা ব্যাপার রয়েছে। যেমন, লোকাল ভাড়া নেয়ার কোন সিস্টেম নেই।
আপনি একা হোন আর দলগত হউন না কেন… আপনাকে লঞ্চ বা ট্রলার রিজার্ভ ভাড়া নিতে হবে। আমি তো আবার একা। লঞ্চ ভাড়া অনেক বেশি। আর একটা লঞ্চে যাত্রী ১ জন মানে আমি একা। ব্যাপারটা কেমন বেশি রাজকীয় হয়ে যায় না। একটা ট্রলার এর কাছে গেলাম। দেখি বাপ বেটা দুইজন ই খুটি নাটি কি বিষয় নিয়ে যেন কাজ করছে। আমাকে দেখে বলল যাবেন? বললাম হ্যাঁ যাবো। ভাড়া কত? ১৪০০ টাকা। কম কত। কম নাই!
কিছুক্ষন কথা বলে বুজলাম ভাড়া কম হবার নয়। এদিকে সময় ও চলে যাচ্ছে। রাজি হয়ে গেলাম… আমাকে বলল, সাথে শুকনো খাবার আর পানি নিয়ে নেন। সমুদ্রের পানি নোনা আর ওইখানে যে পানি পাওয়া যায় তার দাম অনেক বেশি। আমি পানি আর শুঁকনো কিছু খাবর নিয়ে নিলাম। ট্রলার ছেড়ে দিল। দুই পাশে লোকালয় রেখে একটা নালার ভিতর দিয়ে আমাদের ট্রলার এগিয়ে চলল। কিছু দূর যাওয়ার পর বড় নদী তে চলে আসল আমাদের ট্রলার। আমি ট্রলার এর ছাদে উঠে আসলাম। প্রচন্ড রৌদ। আমাকে একটা ছাতা দেয়া হল। কিছুক্ষন চলার পর ট্রলার বা দিকে মোর নিল।
প্রায় ১ ঘন্টার মত চলার পর ছোট ছেলেটি আমাকে হাত দিয়ে ইশারা করে দেখাল… ওই যে দেখেন কিছু জায়গা কালো দেখা যাচ্ছে। ওইটা ই সুন্দরবন। আমি ও দেখলাম। অনেক দূরে একটা জঙ্গল দেখা যাচ্ছে। ওই তো সুন্দরবন! আমার একটা স্বপ্ন পুরন হবার সময় চলে আসছে। বইয়ের পাতা আর কম্পিউটার এর স্কিন এ দেখা সেই সুন্দরবন আমার চোখের সামনে।
এখন আর এক পাশে কোন লোকালয় দেখা যাচ্ছে না। শুধু পানি আর পানি। আর অন্য পাশে সুন্দরবন। আমি ট্রলার এর ছাদ থেকে নিচে নেমে আসলাম। হাত দিয়ে পানি নিলাম। জিব্বাহ লাগালাম। সত্যি নোনতা পানি। আমি এর আগে কখনো নোনা পানির স্বাদ নেই নি। বই এ শুনেছি মাত্র। আসলে জীবনে যেটা ই প্রথম ঘটে থাকে তা সত্যি দারুণ এক অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে। আর ওই সময় টা কি যে আনন্দের হয় তা বলে বুজানো মুশকিল। আমরা এসে পৌছালাম সুন্দরবন এ! আহা সুন্দরবন!
ট্রলার থামতেই নেমে পড়লাম। প্রবেশপথে ছোট্ট একটা যাদুঘর, যেখানে সংরক্ষিত আছে বাঘ, হরিণসহ বিভিন্ন প্রাণীর অংশ। পাশে একটা ছোট চিড়িয়াখানায় কুমির, হরিণ ইত্যাদিও আছে। তারপর সুন্দরবনের ভেতরে হাঁটা শুরু করলাম। কাঠের তৈরি পথ দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে দেখলাম, চারপাশে শুধু গাছ আর গাছ। সুন্দরী, গরান, বাইনসহ নানা জাতের গাছ। নিচে লাল কাঁকড়ার ছড়াছড়ি! একটা ধরার চেষ্টা করতেই মুহূর্তে গর্তে ঢুকে গেল।
একটু গভীরে যেতেই সঙ্গী ছেলেটা থেমে বলল, “আর বেশি ভেতরে যাওয়া ঠিক হবে না, বাঘের এলাকা!” কথাটা শুনে একরকম শিহরণ বয়ে গেল শরীরে। কিছুক্ষণ প্রকৃতির শূন্যতা অনুভব করলাম, তারপর ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম।
এক বোতল নোনা পানি সংগ্রহ করলাম স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে। ট্রলারে উঠে পড়লাম, এবার ফেরার পালা। সুন্দরবনের মোহময়তা পিছনে ফেলে ছুটতে লাগল ট্রলার। এই ভ্রমণের প্রতিটি মুহূর্তই ছিল শিহরণ জাগানো—অজানা পথে একা যাত্রা, অচেনা গন্তব্য, প্রকৃতির নিরবতা আর আবিষ্কারের রোমাঞ্চ। সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দর্য সত্যিই আমাকে মুগ্ধ করেছে। এটা শুধু একটা ভ্রমণই ছিল না, ছিল এক অজানা অভিযাত্রার অভিজ্ঞতা।
মূল লেখা: সুন্দরবন ভ্রমণ
দুপুরে গোসল করে লাঞ্চ করে নিলাম। এবার ব্যাকপ্যাক গুছানোর পালা। কয়েটা শার্ট প্যান্ট, তোয়ালে, পারফিউম, মোবাইল চার্জার, আমার নোট খাতা, ম্যাপ, টুথব্রাশ ইত্যাদি ব্যাগ এ ঢুকিয়ে নিলাম। ব্যাগ গুছিয়ে মোফাজ্জেলের মেসে গেলাম। ওর কাছ থেকে ওর নকিয়া ৬৬০০ মোবাইলটা নিলাম, কারণ ওর মোবাইলের ক্যামেরায় ভালো ছবি উঠত। তারপর ছুটলাম কুমিল্লা রেলস্টেশনের দিকে।
আরও: কাপ্তাই লেক: প্রকৃতির কোলে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা
ঢাকা যাত্রা ও ট্রেনের বিড়ম্বনা
কুমিল্লা রেলওয়ে স্টেশন এ এসে ঢাকার জন্য এটা টিকেট কাটতে গেলাম। আমকে বলল ট্রেন এর টিকিট নাকি শেষ! এরপর রাত ৮টার দিকে যেটা আসবে সেটার টিকেট কাটার জন্য বলছে। কিন্তু কথা হল, আমি তো এখান থেকে ঢাকায় পৌছে আবার রাতের ট্রেনেই খুলনা যাবো। এখন যদি এখান থেকে ই রাতের ট্রেনে যাই তাহলে ঢাকায় পৌছাতে পৌছাতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। আর আমার খুলনার ট্রেন টা ও মিস হয়ে যাবে।
টিকেট কাউন্টারে বললাম, এই ট্রেনে যাওয়ার কি কোন উপায় আছে? আমাকে তারা বলল, আপনি চাইলে দাড়িয়ে যেতে পারেন তবে সেক্ষেত্রে ও কিন্তু আপনাকে টিকেট কাটতে হবে এবং সম্পুর্ন টিকিটের টাকা দিতে হবে। কি আর করা… খুলনার ট্রেনের কথা ভেবে টিকিট কেটে নিলাম। সময় তখন বিকাল ৪ টা এর মত বাজে। প্রায় দের ঘন্টা অপেক্ষা করার পর ট্রেন আসল কিন্তু একি, ট্রেনে যে মানুষ আর মানুষ! এতো মানুষ, যে ট্রেন ই ঠিক মত দেখা যাচ্ছে না! বহু কষ্টে ট্রেনে উঠলাম ঠিক কিন্তু বসার তো দুরের কথা দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়া ই ভার।
যাইহোক কোন রকম ভাবে একপাশে দাড়াতে পারলাম তাও অনেক ঠেলে ঠুলে। ট্রেন চলতে লাগল। একের পর এক স্টেশন এ দাঁড়াচ্ছে আর লোকজন উঠছে হু হু করে। তখন কি যে বিরক্ত লাগছিল নিজের কাছে। আরো বেশি বিরক্ত আর টেনশন হচ্ছিল ট্রেন চলার গতি দেখে। যাকে কচ্ছপ গতি বলে। আমাদের ট্রেন যখন ঢাকার কাছাকাছি তখন, এক ভদ্রলোক আমাকে তার সীট এর হাতলে বসার সুযোগ করে দিলেন। কাধে ব্যাগ নিয়ে দাড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার পা অবশ হয়ে গিয়েছিল। হাতলে বসে দুনিয়ার সব সুখ খুজে পেলাম আমি। এভাবে ই ঢাকা কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন পৌছালো ট্রেন।
রাত ১২ঃ২৭!
ট্রেন থেকে বের হয়ে ই একটা পানির বোতল নিয়ে পানি খেলাম। তারপর সোজা চলে গেলাম টিকিট কাউন্টারে। খুলনার ট্রেন নাকি ইতিমধ্যে ই স্টেশন ছেড়ে চলে গিয়েছে! মনটাই খারাপ হয়েগেলো। একটা রিক্সা নিয়ে ছুটে গেলাম বাস স্টেশন এ। শুনেছি কপালে যেদিন খারাপ লেখা থাকে সেদিন নাকি, সবদিক দিয়ে ই খারাপ হয়। বাসের কাউন্টার গুলো বন্ধ। কয়েকজন কে জিজ্ঞের করে জানতে পারলাম। আজ রাতে খুলনার শেষ বাসটি ছেড়ে চলে গিয়েছে। আগামী কাল ছাড়া আর কোন বাস খুলনার উদ্দেশে ছেড়ে যাবে না।
বাধ্য হয়ে ফিরে আসলাম হোটেল এর খোঁজে। স্টেশন এর পাশে ই কিছু হোটেল পেলাম মোটামুটি মানের। ২ স্টার বলা যায়। একটা হোটেলের রিসিপসনে গিয়ে একরাতের জন্য একটি রুম ভারা নিলাম। ২য় তলায় আমার রুম । রুম এর চাবি নিয়ে ২য় তলায় উঠে আমার রুমে ঢুকলাম। যতটা খারাপ হবে ভেবেছিলাম রুম ততটা খারাপ না। রুমে এসি নেই ঠিক তবে, স্মার্ট টিভি থেকে শুরু করে সব কিছুই ছিল। একে তো ট্রেনে দাড়িয়ে এসেছি। তারউপর আবার ট্রেন মিস, বাস মিস! সব কিছু মিলিয়ে খুব ক্লান্তি বোধ করছিলাম। জামা কাপড় ছেড়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে গোসল করে নিলাম। ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে এসে ডিনার এর জন্য হোটেল থেকে বের হলাম। রাত তখন আনুমানিক ১ঃ৩৮ এর মত বাজে। খাবারের প্রায় হোটেল গুলো ই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অনেক খুঁজাখুঁজির পর একটা পেলাম। ডিনার শেষে রুমে ফিরে এসেই ফ্রেশ একটা ঘুম দিলাম।
খুলনায় পৌঁছানো ও প্রথম রাত
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ব্যাগ গুছিয়ে হোটেল থেকে বের হয়ে গেলাম। একটা রেস্টুরেন্ট এ ঢুকে সকালের নাস্তা করে নিলাম। তারপর সোজা গাবতলি বাস স্ট্যান্ড। গাবতলি আমার কাছে নতুন এক জায়গা। আগে কখনো আমি এখানে আসিনি। হানিফ পরিবহনে একটা টিকিট কাটলাম খুলনার জন্য। বাস ছাড়বে দুপুর ১ঃ৩০ মিনিটে। ঘড়িতে সময় বাজে তখন ১১ঃ ৫৫। কাউন্টারে বসে আছি। একটা ছোট্র ছেলে বসে আছে আমার পাশে। সময় কাটানোর জন্য ওর সাথে গল্প শুরু করলাম। ওর নাম রফিক। বাসা খুলনার কাছে কি যেন একটা জায়গার নাম বলল। আমার ঠিক মনে নেই। ওর বাবা ও আছে ওর সাথে। রফিক ৪র্থ শ্রেনিতে পড়ে। ছেলেটা বেশ ভালোই। আমাকে খুলনা সম্পর্কে অনেক কিছু জানালো। কথা চলতে থাকল ওর সাথে।
আমাদের বাস ছেড়েছে ১ঃ৪০ এর দিকে। জানালার পাশে আমার সিট। টিকিট কাটার সময়ই বলেছি যাতে আমাকে বাসের মাঝামাঝি এবং হাতের বা দিকে জানালার পাশে সিট দেয়। ওনি সেটা ই করেছেন। বাসে উঠার আগে অবশ্য দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়েছি। সাথে শুঁকন খাবার আর পানি নিয়েছি। এটা লং জার্নির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাসে উঠার আগে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে নেয়া জরুরি। এতে আপনার বাস ভ্রমন হবে আরাম দায়ক। না হলে ভিতর থেকে চাপ আসলে কেস্কি মারা ছাড়া উপায় থাকবে না। ভ্রমন হবে বিদঘুটে।
বাস চলছে। আমি কানে হেডফোন লাগিয়ে পুরন দিনের বাংলা এবং হিন্দি গান শুনছি। যে কোন জার্নিতে আমার পুরন দিনের গান অনেক ভালো লাগে। সময় টা কে অনেক উপভোগ্য করে তোলে। বাসের জানালা কাচের ভিতর দিয়ে বাহিরের দৃশ্য উপভোগ করছি। আর বাস চলছে শাঁ শাঁ করে। মাঝপথে একবার বিরতি দিয়ে আবার বাস চলতে থাকল। বিরতিতে সবাই ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নিল যারযার মত। আমিও করলাম।
রাত ১১ এর উপরে। আমার হাতের বা দিকে ষাট গম্বুজ মসজিদ রেখে বাস এগিয়ে চলল খুলনার সর্বশেষ বাস স্টেশন এ। রাতে বাস এর টিপ শেষে শহর থেকে দূরে এখানে এসেই বাসগুলো রাখা হয়। খুলনা শেষ বাস স্ট্যান্ড এ বাস পৌছাতে পৌছাতে বাস প্রায় খালি হয়ে গিয়েছে। রফিক ইতিমধ্যে তার বাবার হাত ধরে বাস থেকে নেমে পরেছে। সর্বশেষ বাস স্ট্যান্ডে এসে আমারা ছিলাম মাত্র ৪ জন। এর ভিতর বাস ড্রাইভার ১ জন, হেল্পার ১ জন আর আমরা বাস যাত্রী ২ জন। বাস কন্ট্রাক্টর আগেই নেমে পড়েছে। যাক অবশেষে আমি খুলনায় পৌছালাম।
---
বাস থেকে নেমেছিতো ঠিক কিন্তু একি…! এ আমি কোথায় আসলাম!! চারদিকে শুধু অন্ধকার। কোন লোকালয় নেই। জনমানব শূন্য। প্রথমে একটু ভরকে গিয়েছিলাম। পরক্ষনে ভালো করে তাকিয়ে দেখি অনেক দূরে একটা লাইট জ্বলছে। আলো লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলাম। এরকম রাত বিরাতে আমার চলতে তেমন ভয় লাগে না। এমনি একটা রাতে পৌছে ছিলাম খগড়াছড়ি তে। ওই খানে চারপাশে আলো ছিল। কারন ওটা ছিল একটা ছোট খাটো বাজার। কয়েকটা দোকান খোলা ছিল। কিন্তু কোন হোটেল দেখতে পাচ্ছিলাম না।
আমার রাতে থাকার জন্য একটা হোটেল দরকার ছিল। আশেপাশে কোথাও হটেল আছে কিনা সেটা জানার দরকার ছিল। কাউকে জিজ্ঞেস করতে যাব ভেবে একটা দোকানের দিকে যাওয়া শুরু করেছিলাম মাত্র। আমি থমকে দাড়িয়ে গেলাম। আমি একা। আমার সাথে টাকা পয়সা ছিল। মোবাইল ছিল। ছিল ল্যাপটপ ও। আরো অনেক কিছু। রাত তখন ১ টার উপরে বাজে। এতো রাতে একটা ছেলেকে পেয়ে তার কাছ থেকে সব কিছু নিয়ে নেয়া ব্যাপার না। তাছাড়া আমি তো কাউকে চিনিও না। কোন লোকটা ভালো?
এরকম পরিস্থিতিতে আমার স্টাডি বলেঃ প্রথমে দেখো কোন হোটেল আছে কিনা। হোটেল না পেলে দেখো কোন ডাক্তার এর চেম্বার বা দোকান খোলা আছে কিনা। কারন ডাক্তার ৯৫% ভালো লোক হয়। আমি তাদের পেশার কথা বলছি না কিন্তু! আমি ও তাদের কে মাঝে মাঝে সুযোগ পেলে কষাই বলে ডাকি। যদিও আমার পরিবারে আমার বাবা এবং মেঝো ভাই ডাক্তার। আলোর দিকে এসে দেখি একটা ছোট্র ভাতের দোকান, তার ভিতরে ২ জন লোক বসে আছে। একজন এর বয়স ৫০ এর উপরে হবে। সে টাকা গুনছে। দেখে মনে হল সারাদিন এর ইনকাম এর হিসাব করছে। আরেকজন পিচ্ছি ছেলে বসে আছে। বয়স ১০-১৫ এর মত হবে।
আমি কাছে যেয়ে বললাম। খাবার এর কি কিছু আছে? টাকা গুনতে গুনতে লোকটা বলল এই ওনাকে খাবার দে। আমাকে বলল, আপনি বসেন। পিচ্চি ছেলেটা বলল, কি দিব…? মাছ, মুরগি, ভর্তা, ডাল… কি দিব? হোটেল এর মুরগির উপর আমার ভরসা কম। তাই বললাম মাছ আর ডাল দাও। ভর্তা আমার ভালো লাগে না।
খেতে খেতে পিচ্চিকে জিজ্ঞেস করলাম এখানে থাকার হোটেল আছে? হ্যাঁ আছে তো। আমি খাওয়া বন্ধ করে ওকে জিজ্ঞেস করলাম কোথায়? কত দূর এখান থেকে। বেশি দূরে না… হাইটা ই জাইতে পারবেন। ওই যে দেখেন না লাইট টা জলতাছে। ওইটা ই হোটেল। আমি ঘড় ফিরিয়ে দেখলাম, আরে তাই তো । আমি তো খেয়াল ই করিনি। খাবার হোটেল থেকে খুব ভালো করেই দেখা যাচ্ছে লাইট এর আলো। আমি খাওয়া শেষ করে টাকা দিয়ে আবার আলোর পথে ছুটলাম।
৩ তলা বিশিষ্ট একটা আবাসিক হোটেল। হোটেল টা দেখে মন হল বেশিদিন হয় নি এটার বয়স। হোটেল এর সামনে গিয়ে দেখি, গেটে কোন দারওয়ান নেই। আমি গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। রিসিপসনে লাইট জ্বলছে। কিন্তু কেউ নেই! আমি কিছুক্ষন দাড়িয়ে থেকে তারপর সোফায় বসলাম। প্রায় ৭ মিনিট পর একজন মধ্যবয়স্ক লোক আসল। আমাকে দেখে বলল কোথা থেকে এসেছেন। ঢাকা থেকে। হোটেল এ থাকব ১ রাত।
লোকটি আমাকে হোটেল ভাড়ার একটা চার্ট দিলেন এবং কতদিন থাকব জিজ্ঞেস করলেন। সাথে আমাকে একটা ফর্ম দিলেন পুরন করার জন্য। আমি হোটেল এর টাকা দিয়ে রুম এর চাবি নিয়ে ২য় তলায় চলে আসলাম। আমার রুম এর সাথে একটা বারান্দা ও আছে। রুমে কোন টিভি নেই। বাথরুম এর ঝর্না নষ্ট। আরো কত হাবি যাবি। আমি কোন রকমে গোসল করে ঘুম দিলাম। মোবাইলে এলার্ম দিয়ে রাখলাম সকাল ৬টার। খুব ভোরে উঠতে হবে।
খানজাহান আলীর মাজার
সকালে রিকশা ঠিক করলাম। প্রথম গন্তব্য খানজাহান আলীর মাজার। রিকশাওয়ালা সতর্ক করলেন, এখানে অনেক ভণ্ড লোক থাকে যারা নানা কৌশলে টাকা হাতিয়ে নেয়। মাজারের সামনে পৌঁছাতেই দেখলাম, উনি যা বলেছিলেন, তা-ই ঘটছে। অনেক দোকানদার মোমবাতি, আগরবাতি, গোলাপ জল ধরিয়ে দিতে চাইছে। আমি কোনো দিকে না তাকিয়ে মাজারের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। কিছু সময় সেখানে কাটিয়ে বেরিয়ে এলাম।
ষাট গম্বুজ মসজিদ
পরবর্তী গন্তব্য বাগেরহাটের ঐতিহাসিক ষাট গম্বুজ মসজিদ। মসজিদের প্রবেশদ্বারে টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকে বিস্মিত হলাম—অসাধারণ স্থাপত্য! প্রতিটি গম্বুজ যেন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মসজিদের পেছনে বিশাল দিঘী, তার পাড়ে গিয়ে কিছুক্ষণ বসলাম।
এরপর রিকশা করে বাসস্ট্যান্ডে ফিরে এলাম, এবার মংলার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। কারণ সেখান থেকেই শুরু হবে সুন্দরবনের আসল অভিযান!
সুন্দরবন যাত্রা
বাস স্ট্যান্ড থেকে বাসে চড়ে চলে আসলাম মংলা। সময় লাগল প্রায় দের ঘন্টার মত। বাস থেকে নামতে যাবো। কয়েকজন এসে রীতিমত টানাটানি শুরু করে দিল। চলেন আমার ট্রলারে… আরেকজন বলছে চলেন আমার লঞ্চে। আমি পাশকাটিয়ে চলে আসলাম। প্রচন্ড রৌদ্র। আশেপাশে বেশ কিছু দোকানপাট রয়েছে। আমি দুপুরের লাঞ্চ সেরে নিলাম। লাঞ্চ করতে করতে যতটুকু বুজলাম এখানে আমার মত কেউ একা আসে না।
দলবল নিয়ে আসে। কেউ ফ্যামিলি নিয়ে আসছে, আবার কেউ বন্ধু বান্ধব নিয়ে আসছে। হইহুল্লোর করছে। আবার অনেকে গরমে ইংরেজি V এর মত পা ছড়িয়ে বসে আছে। আমি লাঞ্চ শেষ করে হাটতে হাটতে মংলা ঘাট এ চলে আসলাম। বাস থেকে যেখানে নেমেছি এটা তার থেকে বেশি দূরে নয়। আজকে আকাশ ভালো ই মনে হচ্ছে। বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। লোকজন আসছে আর ট্রলার, লঞ্চ এ করে সুন্দরবন এর উদ্দেশ্যে আনন্দ করতে করতে ছুটে যাচ্ছে। এখানে একটা আলাদা ব্যাপার রয়েছে। যেমন, লোকাল ভাড়া নেয়ার কোন সিস্টেম নেই।
আপনি একা হোন আর দলগত হউন না কেন… আপনাকে লঞ্চ বা ট্রলার রিজার্ভ ভাড়া নিতে হবে। আমি তো আবার একা। লঞ্চ ভাড়া অনেক বেশি। আর একটা লঞ্চে যাত্রী ১ জন মানে আমি একা। ব্যাপারটা কেমন বেশি রাজকীয় হয়ে যায় না। একটা ট্রলার এর কাছে গেলাম। দেখি বাপ বেটা দুইজন ই খুটি নাটি কি বিষয় নিয়ে যেন কাজ করছে। আমাকে দেখে বলল যাবেন? বললাম হ্যাঁ যাবো। ভাড়া কত? ১৪০০ টাকা। কম কত। কম নাই!
কিছুক্ষন কথা বলে বুজলাম ভাড়া কম হবার নয়। এদিকে সময় ও চলে যাচ্ছে। রাজি হয়ে গেলাম… আমাকে বলল, সাথে শুকনো খাবার আর পানি নিয়ে নেন। সমুদ্রের পানি নোনা আর ওইখানে যে পানি পাওয়া যায় তার দাম অনেক বেশি। আমি পানি আর শুঁকনো কিছু খাবর নিয়ে নিলাম। ট্রলার ছেড়ে দিল। দুই পাশে লোকালয় রেখে একটা নালার ভিতর দিয়ে আমাদের ট্রলার এগিয়ে চলল। কিছু দূর যাওয়ার পর বড় নদী তে চলে আসল আমাদের ট্রলার। আমি ট্রলার এর ছাদে উঠে আসলাম। প্রচন্ড রৌদ। আমাকে একটা ছাতা দেয়া হল। কিছুক্ষন চলার পর ট্রলার বা দিকে মোর নিল।
প্রথম সুন্দরবনের দেখা
প্রায় ১ ঘন্টার মত চলার পর ছোট ছেলেটি আমাকে হাত দিয়ে ইশারা করে দেখাল… ওই যে দেখেন কিছু জায়গা কালো দেখা যাচ্ছে। ওইটা ই সুন্দরবন। আমি ও দেখলাম। অনেক দূরে একটা জঙ্গল দেখা যাচ্ছে। ওই তো সুন্দরবন! আমার একটা স্বপ্ন পুরন হবার সময় চলে আসছে। বইয়ের পাতা আর কম্পিউটার এর স্কিন এ দেখা সেই সুন্দরবন আমার চোখের সামনে।
এখন আর এক পাশে কোন লোকালয় দেখা যাচ্ছে না। শুধু পানি আর পানি। আর অন্য পাশে সুন্দরবন। আমি ট্রলার এর ছাদ থেকে নিচে নেমে আসলাম। হাত দিয়ে পানি নিলাম। জিব্বাহ লাগালাম। সত্যি নোনতা পানি। আমি এর আগে কখনো নোনা পানির স্বাদ নেই নি। বই এ শুনেছি মাত্র। আসলে জীবনে যেটা ই প্রথম ঘটে থাকে তা সত্যি দারুণ এক অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে। আর ওই সময় টা কি যে আনন্দের হয় তা বলে বুজানো মুশকিল। আমরা এসে পৌছালাম সুন্দরবন এ! আহা সুন্দরবন!
ট্রলার থামতেই নেমে পড়লাম। প্রবেশপথে ছোট্ট একটা যাদুঘর, যেখানে সংরক্ষিত আছে বাঘ, হরিণসহ বিভিন্ন প্রাণীর অংশ। পাশে একটা ছোট চিড়িয়াখানায় কুমির, হরিণ ইত্যাদিও আছে। তারপর সুন্দরবনের ভেতরে হাঁটা শুরু করলাম। কাঠের তৈরি পথ দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে দেখলাম, চারপাশে শুধু গাছ আর গাছ। সুন্দরী, গরান, বাইনসহ নানা জাতের গাছ। নিচে লাল কাঁকড়ার ছড়াছড়ি! একটা ধরার চেষ্টা করতেই মুহূর্তে গর্তে ঢুকে গেল।
একটু গভীরে যেতেই সঙ্গী ছেলেটা থেমে বলল, “আর বেশি ভেতরে যাওয়া ঠিক হবে না, বাঘের এলাকা!” কথাটা শুনে একরকম শিহরণ বয়ে গেল শরীরে। কিছুক্ষণ প্রকৃতির শূন্যতা অনুভব করলাম, তারপর ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম।
বিদায় সুন্দরবন
এক বোতল নোনা পানি সংগ্রহ করলাম স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে। ট্রলারে উঠে পড়লাম, এবার ফেরার পালা। সুন্দরবনের মোহময়তা পিছনে ফেলে ছুটতে লাগল ট্রলার। এই ভ্রমণের প্রতিটি মুহূর্তই ছিল শিহরণ জাগানো—অজানা পথে একা যাত্রা, অচেনা গন্তব্য, প্রকৃতির নিরবতা আর আবিষ্কারের রোমাঞ্চ। সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দর্য সত্যিই আমাকে মুগ্ধ করেছে। এটা শুধু একটা ভ্রমণই ছিল না, ছিল এক অজানা অভিযাত্রার অভিজ্ঞতা।
মূল লেখা: সুন্দরবন ভ্রমণ