বাংলাদেশের সুন্দর সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের অসুন্দর বর্জ্য নিয়ে ভ্রমণ গবেষণা ও বিশ্লেষণাত্মক আর্টিকেল। কক্সবাজার (Cox’s Bazar), বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত। তবে ক্রমবর্ধমান পর্যটনের চাপে এ সৈকতের পরিবেশ বিপর্যস্ত হতে শুরু করেছে। প্লাস্টিক, প্যাকেট, খাবারের উচ্ছিষ্ট ও অন্যান্য বর্জ্য ধীরে ধীরে সৈকতের সৌন্দর্য নষ্ট করছে এবং এর দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশগত প্রভাবও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর সমুদ্রপৃষ্ঠে প্রায় ৮ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলা হয়, যার একটি বড় অংশই পর্যটন কেন্দ্রিক বর্জ্য । কক্সবাজারও এই বিপদ থেকে রেহাই পায়নি। তাই, এই গবেষণায় আমরা বিশ্লেষণ করব কক্সবাজারের বর্জ্য সমস্যার কারণ, এর প্রভাব এবং এর থেকে মুক্তির সম্ভাব্য সমাধান। তাই তো আমি এই ভ্রমণ গবেষণার নাম রেখেছি: সুন্দর সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের অসুন্দর বর্জ্য।
চলুন শুরু করা যাক…
সুন্দর সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের অসুন্দর বর্জ্য
কক্সবাজারের ইতিহাস এবং পরিবেশগত প্রেক্ষাপট
প্রথমে শুরু থেকে শুরু করা যাক। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতটি প্রায় ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং এটি বিশ্বের দীর্ঘতম প্রাকৃতিক বালুর সৈকত হিসেবে পরিচিত। পর্যটকদের জন্য এটি একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য এবং বছরে গড়ে প্রায় ২০ লক্ষ পর্যটক এখানে ভ্রমণে আসেন বা বেড়াতে আসে। তাই এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ পর্যটন শিল্প স্থানীয় জনগণের জীবিকার অন্যতম প্রধান উৎস হিসবে বিবেচিত।


পর্যটন শিল্পের বিকাশের সাথে সাথে সৈকতটি জনবহুল হয়ে উঠেছে এবং এর সাথে বেড়েছে বর্জ্য সমস্যাও। আমি মনে করি, কক্সবাজারের স্থানীয় প্রশাসন যথাযথ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হওয়ায়, সমুদ্রের পানি এবং পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। তবে শুধুমাত্র প্রশাসনকে দ্বায়ী করা যাবে না, এর দ্বায় আমাদের সবার। কিভাবে এর দ্বায় আমাদের সবার আসুন এ নিয়ে বিশ্লেষণ করা যাক।
আরও: কক্সবাজার ভ্রমণ
বর্জ্যের উৎস এবং প্রকৃতি
বর্জ্যের উৎস এবং প্রকৃতি নিয়ে ৩টি ভাগ করা যেতে পারে-


পর্যটকদের দ্বারা সৃষ্ট বর্জ্য
কক্সবাজারের বর্জ্য সমস্যার মূল কারণ পর্যটকদের অবহেলা। সমীক্ষায় দেখা গেছে, পর্যটকরা অধিকাংশ সময় তাদের ব্যবহৃত পণ্য যেমন প্লাস্টিক বোতল, খাবারের প্যাকেট ইত্যাদি যেখানে সেখানে ফেলে যায়। বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক দূষণের ৭০ শতাংশই পর্যটন কেন্দ্রিক । কক্সবাজারে প্রতিদিন প্রায় ১০-১৫ টন (পর্যটকদের উপর ভিত্তি করে কম বেশি হতে পারে) বর্জ্য সৃষ্টি হয়, যার মধ্যে ৫০ শতাংশই পুনর্ব্যবহার অযোগ্য প্লাস্টিক।


স্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা
কক্সবাজারে হোটেল এবং রেস্তোরাঁগুলো থেকেও ব্যাপক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। স্থানীয়ভাবে ২০০টিরও বেশি হোটেল এবং রিসোর্ট থেকে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ বর্জ্য তৈরি হয় । এর মধ্যে খাবারের উচ্ছিষ্ট, প্লাস্টিক, কাগজের প্যাকেট এবং বিভিন্ন ধরণের কেমিক্যাল বর্জ্য থাকে, যা সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত না হলে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে।
স্থানীয় জনগণের বর্জ্য
কক্সবাজারের স্থানীয় জনগণের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও সঠিক অবকাঠামোর অভাবও বর্জ্য সমস্যা বাড়িয়ে তুলছে। ময়লার সঠিক নিষ্পত্তি এবং রিসাইক্লিং সুবিধার অভাবে বর্জ্য সমুদ্রে পৌঁছে যাচ্ছে, যা পরিবেশের ক্ষতি করছে।


বর্জ্যের পরিবেশগত প্রভাব
এবার চলুন এতো বর্জ্য উৎপন্নের ফলে পরিবেশগত ভাবে এর কি প্রভাব ফেলে তা দেখা যাক।
সমুদ্রের উপর প্রভাব
সমুদ্রের পানিতে জমে থাকা প্লাস্টিকের মাইক্রোপার্টিকেল সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রকে ধ্বংস করছে। সামুদ্রিক জীব যেমন কচ্ছপ, মাছ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণী এই প্লাস্টিক গিলে ফেলে, যা তাদের স্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ১০ লক্ষ সামুদ্রিক প্রাণী প্লাস্টিক দূষণের কারণে মারা যাচ্ছে । কক্সবাজারের পরিস্থিতি এর ব্যতিক্রম নয়।
জীববৈচিত্র্যের হুমকি
সমুদ্র সৈকতে কচ্ছপের প্রজননের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ আজ হুমকির মুখে। বর্জ্য জমে থাকায় কচ্ছপের ডিম ফোটানোর স্থান নষ্ট হচ্ছে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর মোট কচ্ছপ প্রজাতির ৬টি প্রজাতিই কক্সবাজারে পাওয়া যায় । তবে পরিবেশ দূষণের কারণে এদের প্রজনন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে, যা কচ্ছপের সংখ্যা দিন দিন কমিয়ে দিচ্ছে।


বায়ু ও মাটি দূষণ
স্থানীয়ভাবে বর্জ্য পোড়ানোর কারণে বাতাসে বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হচ্ছে। এতে স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটকদের স্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। মাটিতে জমে থাকা প্লাস্টিকের কারণে এর উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে, যার ফলে স্থানীয় কৃষিকাজেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
আরও: ইনানী সমুদ্র সৈকত
স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনে প্রভাব
পরিবেশগত দূষণ কেবলমাত্র সমুদ্রের উপরই নয়, স্থানীয় জনগণের জীবিকা এবং স্বাস্থ্যেও প্রভাব ফেলছে। স্থানীয় মৎস্যজীবী ও কৃষকেরা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। দূষিত পানির কারণে মাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, যা স্থানীয় মৎস্যজীবীদের আয়ের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
পরিসংখ্যান বলছে, গত ১০ বছরে কক্সবাজারের মৎস্য শিল্পে ৩০ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে । এছাড়া, দূষিত বাতাস এবং পানির কারণে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, ত্বকের সমস্যা এবং পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বেড়ে যাচ্ছে।


পর্যটকদের ভূমিকা এবং আচরণগত প্রভাব
কক্সবাজারে পর্যটকদের ভূমিকা এবং আচরণগত প্রভাব নিয়ে বিশ্লেষণ করা যাক।
পর্যটকদের অবহেলা
বেশিরভাগ পর্যটকরা যেখানে সেখানে বর্জ্য ফেলে যান। এমনকি বর্জ্য ফেলার নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছানোর জন্য পর্যাপ্ত বিন থাকা সত্ত্বেও তারা তা এড়িয়ে যান। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭৫% পর্যটকই সৈকতে থাকা বিন ব্যবহার করেন না । এর ফলে সৈকতের সৌন্দর্য ও পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। তবে বিন (ময়লা ফেলার স্থান) এর ব্যাপারে আরও মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। ছোট বিনের পাশাপাশি কিছু দূর পরপর বড় সাইজের বিন রাখা যেতে পারে। এতে ময়লা ফেলার স্থান গুলো পর্যটকদের সহজেই দৃষ্টিগোচর হবে।
সমুদ্র সৈকতের পরিবেশ যদি ঠিক থাকে তাহলে বিদেশী পর্যটক আসার আগ্রহ বাড়বে। কারন, নোংরা পরিবেশে কারও ভ্রমণ করতে ভালো লাগার কথা নয়।
সচেতনতার অভাব
পর্যটকদের মধ্যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে সচেতনতার অভাব স্পষ্ট।
স্থানীয় প্রশাসন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জ
প্রশাসনিক উদাসীনতা
স্থানীয় প্রশাসন যথাযথভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। জনশক্তির অভাব, পর্যাপ্ত বিনের অভাব এবং বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের সুযোগের অভাবে এই সমস্যা বেড়েই চলেছে।
আইন বাস্তবায়নের অভাব
সৈকতে বর্জ্য ফেলার বিরুদ্ধে আইন থাকলেও তা কার্যকর হয় না। জরিমানা ও শাস্তির ব্যবস্থা থাকলেও পর্যাপ্ত নজরদারির অভাব রয়েছে। তাই এই বিষয়ে আরও সতর্ক হওয়া উচিৎ।
আরও: কেমন বাংলাদেশ চাই?
বর্জ্য দূষণ প্রতিরোধের জন্য উদ্যোগ
এতক্ষণ আমরা বর্জ্য উৎপত্তি এবং সমস্যা নিয়ে বিশ্লেষণ করলাম এবার চলুন এর সমাধানের কি কি উপায় রয়েছে এবং বর্জ্য দূষণ প্রতিরোধের জন্য কি কি উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে তা দেখি।


কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বর্জ্য দূষণ সমস্যার সমাধান করতে হলে পর্যটক, স্থানীয় প্রশাসন এবং সুশীল সমাজের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। বর্তমান পরিস্থিতির উন্নয়নে কয়েকটি কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদী সমাধান হিসেবে কার্যকর হতে পারে।


স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগ
প্রশাসনের অন্যতম প্রধান ভূমিকা হতে পারে একটি সুসংহত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। বর্তমানে কক্সবাজারের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা দুর্বল, তবে কিছু নতুন পদক্ষেপ এই সমস্যার সমাধানে সহায়ক হতে পারে। নিচে তার কয়েকটি সমাধানের উপায় বলা হল-
বর্জ্য বিন স্থাপন এবং রক্ষণাবেক্ষণ: আগেই বলেছি পর্যাপ্ত বর্জ্য বিনের অভাব কক্সবাজারে একটি বড় সমস্যা। সৈকতের বিভিন্ন অংশে পর্যাপ্ত বিন স্থাপন করা উচিত, যেখানে প্লাস্টিক, খাবারের উচ্ছিষ্ট এবং অন্যান্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য ও অ-পুনর্ব্যবহারযোগ্য বর্জ্য আলাদাভাবে রাখা যাবে।
বিন নিয়মিত খালি করা: স্থানীয় প্রশাসনকে নিশ্চিত করতে হবে যে বিনগুলি সময়মতো খালি করা হচ্ছে। প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে শ্রমিক নিয়োগ এবং সৈকতের পরিষ্কার কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত।
বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের সুযোগ: পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণগুলি সংগ্রহ করার জন্য একটি কার্যকরী পুনর্ব্যবহার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। স্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুক্ত করে পরিবেশবান্ধব পণ্য তৈরি ও ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
আইন প্রয়োগের জোরদার: বর্জ্য ফেলা এবং পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে আইন কার্যকর করতে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। প্রশাসনকে পর্যটকদের দায়িত্বশীল আচরণের জন্য নির্দিষ্ট বিধি প্রণয়ন করতে হবে এবং নিয়ম ভাঙার জন্য জরিমানা ও শাস্তির ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।


পর্যটকদের আচরণ পরিবর্তন
বর্জ্য সমস্যার সবচেয়ে বড় সমাধান হতে পারে পর্যটকদের আচরণের পরিবর্তন। এ ক্ষেত্রে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দায়িত্বশীল পর্যটনের ধারণা প্রসারিত করা যায়। বর্জ্য আমরাই উৎপন্ন করি, তাই আমরা যদি সচেতন হই তাহলে এই সমস্যার দ্রুত সমাধান হবে।
সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন: প্রশাসন ও স্থানীয় বেসরকারি সংস্থাগুলো একত্রিত হয়ে পর্যটকদের জন্য সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালাতে পারে। সৈকতের প্রত্যেকটা বিচে এবং হোটেলগুলোতে বড় ব্যানার, পোস্টার ও ভিডিও ক্লিপের মাধ্যমে পর্যটকদের সচেতন করা যেতে পারে।
দায়িত্বশীল পর্যটকদের জন্য প্রণোদনা: যারা সঠিকভাবে বর্জ্য নিষ্পত্তি করে বা পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহার করে, তাদের পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, হোটেল বা রিসোর্টে ডিসকাউন্ট দেওয়া যেতে পারে এমন পর্যটকদের যারা পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেয়।
বর্জ্য ফেলার বিশেষ স্থান চিহ্নিত করা: সৈকতের বিভিন্ন অংশে পর্যটকদের জন্য বিশেষ চিহ্নিত স্থান তৈরি করা উচিত, যেখানে তারা সহজেই বর্জ্য ফেলে যেতে পারে।
প্লাস্টিক নিষিদ্ধকরণ: একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানোর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। স্থানীয় হোটেল, রেস্তোরাঁ এবং দোকানগুলোতে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ, কাপ এবং পাত্র ব্যবহারের নিয়ম চালু করতে হবে। আমি যখন “সুন্দর সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের অসুন্দর বর্জ্য” নিয়ে গবেষণা আর্টিকেল লিখছি তখন ইতিমধ্যে সরকারী ভাবে পর্যটন স্থান গুলোতে পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও বেসরকারি সংস্থার ভূমিকা
কক্সবাজারের বর্জ্য সমস্যার সমাধানে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিও এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সংস্থাগুলো বেশ কয়েকটি কার্যকরী উদ্যোগ নিতে পারে। আমরা জানি যে, বিডি ক্লিন সহ বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী যুব সংগঠন এই কাজে নিয়োজিত রয়েছে। তবে অন্যান্য সংস্থাগুলো এগিয়ে আসা উচিৎ বলে মনে করি।
“Beach Clean-up” কার্যক্রম: স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো নিয়মিত সৈকত পরিষ্কার কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। পর্যটক এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে এতে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, “Keep It Clean” নামে একটি প্রোগ্রাম চালু করা যেতে পারে, যেখানে পর্যটকরা নির্দিষ্ট সময়ে সৈকত পরিষ্কার করতে সহায়তা করতে পারেন।
সচেতনতা বৃদ্ধি ও শিক্ষা কর্মসূচি: স্থানীয় স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরিবেশ সংরক্ষণ এবং দায়িত্বশীল পর্যটনের উপর সচেতনতা কর্মসূচি চালানো যেতে পারে।
স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা: স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে বিশেষ কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে, যেখানে তারা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানতে পারবেন এবং কীভাবে এটি তাদের জীবনের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে তা উপলব্ধি করবেন।


টেকসই পর্যটন এবং এর ভবিষ্যত
“টেকসই পর্যটন” ধারণাটি এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে পর্যটন পরিবেশের ক্ষতি না করে স্থানীয় জনগণের জন্য লাভজনক হয়। কক্সবাজারের মতো একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রে এই ধরনের টেকসই পর্যটন ব্যবস্থা চালু করা অত্যন্ত জরুরি।
Eco-Tourism ধারণা: ইকো-ট্যুরিজম বা পরিবেশবান্ধব পর্যটন ধারণা চালু করতে হবে। এর মাধ্যমে পর্যটকরা প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন এবং স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হতে পারবেন, তবে তাদের কার্যকলাপের মাধ্যমে পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব কমবে।
টেকসই অবকাঠামো গঠন: টেকসই পর্যটনের অংশ হিসেবে পরিবেশ বান্ধব অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে সোলার পাওয়ার চালিত রিসোর্ট, প্লাস্টিক-মুক্ত হোটেল, এবং পরিবেশবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থা।
পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্যের ব্যবহার: পর্যটকদের পুনর্ব্যবহারযোগ্য এবং পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। পর্যটন শিল্পের বড় বড় কোম্পানিগুলোর সহযোগিতায় “Go Green” ক্যাম্পেইন চালু করা যেতে পারে, যেখানে তারা পর্যটকদের পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহার করতে উৎসাহিত করবে।
….
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত বাংলাদেশের জন্য একটি গর্বের নিদর্শন, যা দেশের পর্যটন শিল্পে অনন্য অবদান রাখে। তবে বর্তমানে যে বর্জ্য সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করেছে, তা আমাদের এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বর্জ্য দূষণের কারণে সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হচ্ছে, স্থানীয় জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হচ্ছে এবং পর্যটনের সুযোগ কমে যাচ্ছে।
এই সমস্যা সমাধানের জন্য একত্রিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রশাসনের সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পর্যটকদের সচেতনতা, স্থানীয় জনগণের সহযোগিতা এবং এনজিওদের প্রচেষ্টার মাধ্যমে কক্সবাজারকে একটি পরিবেশবান্ধব ও টেকসই পর্যটন গন্তব্য হিসেবে পুনঃস্থাপন করা সম্ভব।
বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো ইতিমধ্যে টেকসই পর্যটন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে যে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, সেগুলোর উদাহরণ অনুসরণ করে কক্সবাজারেও একই ধরণের পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। এভাবে আমরা কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পরিবেশ রক্ষা করতে পারব এবং আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারব।
আরও: বাংলাদেশের গ্রামীণ মেলা কি হারিয়ে যেতে বসেছে?
কক্সবাজারের বর্জ্য সম্পর্কিত পরিসংখ্যান


বর্জ্য উৎপাদন এবং ব্যবস্থাপনা
- প্রতি বছর ৮ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রের মধ্যে ফেলা হয় (UNEP রিপোর্ট, ২০২০)।
- সমীক্ষায় দেখা গেছে, কক্সবাজারে প্রতি মাসে গড়ে ৫০০-৬০০ টন বর্জ্য জমা হয়, যার মধ্যে প্রায় ৪০% প্লাস্টিক (স্থানীয় প্রশাসনের তথ্য)।
- পর্যটন মৌসুমে কক্সবাজারের সৈকতে ১৫০-২০০ টন বর্জ্য জমা হয় প্রতি সপ্তাহে (পরিবেশ সংস্থা রিপোর্ট)।
পর্যটকদের আচরণ
- সমীক্ষায় দেখা গেছে, কক্সবাজারে পর্যটকদের মধ্যে ৭৫% পর্যটক সৈকতে বিন ব্যবহার করেন না।
- প্রতি ১০ জন পর্যটকের মধ্যে ৬ জন প্লাস্টিক বোতল বা প্যাকেট সৈকতে ফেলে যান (পর্যটন সমীক্ষা, ২০২৩)।
- পর্যটকদের মধ্যে মাত্র ২০% সচেতনভাবে পুনর্ব্যবহারযোগ্য বা পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহার করেন।
বর্জ্যের প্রভাব
- গত ১০ বছরে কক্সবাজারের মৎস্য শিল্পের প্রায় ৩০% ক্ষতি হয়েছে শুধুমাত্র সমুদ্র দূষণের কারণে (স্থানীয় মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান)।
- বর্জ্যের কারণে কক্সবাজারের প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের ২৫% ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং কিছু এলাকা ইতোমধ্যে বিপন্ন অবস্থায় আছে (বৈশ্বিক পরিবেশ প্রতিবেদন)।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম
- ২০২৩ সালে প্রায় ৫,০০০ স্বেচ্ছাসেবক প্রতি মাসে সৈকত পরিষ্কারের জন্য অংশগ্রহণ করেছে, যার ফলে ২০,০০০ কেজি প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল (স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা রিপোর্ট)।
- সমুদ্র পরিষ্কার কার্যক্রমের মাধ্যমে গত বছরে ১০০ টন বর্জ্য সমুদ্র থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে (স্থানীয় NGO রিপোর্ট)।
টেকসই পর্যটন
- কক্সবাজারে ইকো-ট্যুরিজমের প্রবর্তন থেকে শুরু করে টেকসই পর্যটনের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া পর্যটকের সংখ্যা প্রতি বছর ১৫% বৃদ্ধি পাচ্ছে।
- টেকসই পর্যটনের জন্য স্থানীয় হোটেল এবং রিসোর্টগুলোর ৪০% বর্তমানে পরিবেশবান্ধব পণ্য ও পরিষেবা প্রদান করছে।
পরিসংখ্যান ও তথ্যসূত্র
- বর্জ্য উৎপাদন সম্পর্কিত তথ্য: প্রতি বছর সমুদ্রপৃষ্ঠে প্রায় ৮ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলা হয় (UNEP রিপোর্ট, ২০২০)।
- কক্সবাজারে পর্যটকের সংখ্যা: ২০২৩ সালে প্রায় ২০ লক্ষ পর্যটক কক্সবাজার ভ্রমণ করেছে।
- মৎস্য শিল্পের ক্ষতি: গত ১০ বছরে কক্সবাজারের মৎস্য শিল্পে ৩০ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে (স্থানীয় প্রশাসনের রিপোর্ট)।
- পর্যটকদের আচরণ: সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭৫% পর্যটক সৈকতে বিন ব্যবহার করেন না।
তথ্যসূত্র
- United Nations Environment Programme (UNEP)।
- বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন।
- স্থানীয় প্রশাসনের বার্ষিক প্রতিবেদন, ২০২৩।
ফেসবুক: কুহুডাক