ট্রাভেলে বাংলাদেশের সম্ভাবনা কেমন? জি, আপনাকে বলছি। ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন, মাতৃভূমি বাংলাদেশকে ভালোবাসেন কিন্তু কখনো ভেবে দেখেছেন ট্রাভেলে বাংলাদেশের সম্ভাবনা কেমন? আসেন আজকে একটু এটা নিয়ে আলোচনা করি।
ভ্রমণপ্রেমী একজন মানুষ হিসেবে আমি অনেক দেশ ঘুরেছি, অনেক সংস্কৃতি দেখেছি, অনেক ট্রাভেলার বা ভ্রমনপ্রিয় মানুষের সাথে গল্প করেছি। কিন্তু যতই ঘুরি না কেন, মনে হয় আমাদের নিজের দেশ বাংলাদেশকেই আমরা এখনো ঠিকমতো চিনে উঠতে পারিনি। বিশেষ করে ট্রাভেল বা ট্যুরিজম নিয়ে যখন ভাবি, তখন মনে হয়, বাংলাদেশ যেন একটা সুপ্ত সোনার খনি, যার ভেতরে অগণিত রত্ন লুকিয়ে আছে। শুধু দরকার একটু সঠিক পরিকল্পনা, আন্তরিক প্রচেষ্টা আর মানসিকতার পরিবর্তন।
আজ আমি চেষ্টা করব খুব সাধারণভাবে আমার দেখা ও ভাবনা থেকে ব্যাখ্যা করতে, কেন বাংলাদেশ ট্রাভেল ইন্ডাস্ট্রির এক বিশাল সম্ভাবনাময় ভূখণ্ড হতে পারে।
আরও: কেমন বাংলাদেশ চাই?
ভৌগোলিক বৈচিত্র্য
বাংলাদেশকে অনেকেই শুধু নদীমাতৃক দেশ হিসেবে চিনে। কিন্তু এর বাইরেও আমাদের আছে পাহাড়, সমুদ্র, বন, গ্রাম, চর, দ্বীপ, জলাভূমি, এবং ঐতিহাসিক শহর। কক্সবাজারের ১২০ কিমি লম্বা সমুদ্র সৈকত, রাঙামাটির নীল পাহাড় আর লেক, সিলেটের চা-বাগান ও জলপ্রপাত, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন, কুয়াকাটার সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, কিংবা বরেন্দ্রভূমির মাটির স্বাদ, এসব কিছুই আমাদের নিজস্ব, মৌলিক এবং ট্রাভেলারের জন্য দুর্দান্ত আকর্ষণীয়।
প্রকৃতির এই বৈচিত্র্য এক জায়গায় পাওয়া দুনিয়ায় খুব কম দেশেই সম্ভব। ইউরোপ বা আমেরিকায় মানুষ একটা সমুদ্র দেখতে কয়েকশ কিলোমিটার পাড়ি দেয়। অথচ আমাদের দেশের ভেতরেই কয়েক ঘণ্টার ভেতরে পাহাড় থেকে সমুদ্র, আবার বন থেকে শহরে পৌঁছে যাওয়া যায়!
সংস্কৃতি ও মানুষের আতিথেয়তা
বাংলাদেশের মানুষ অতিথিপরায়ণ। এটা যতটা বললে বোঝানো যায়, তার চেয়েও বেশি হৃদয়ে গেঁথে থাকে। একজন বিদেশি যখন আমাদের গ্রামে বা মফস্বলে যান, তিনি যা পান তা শুধু খাবার নয়, মানুষের হাসি, খোলা মন, আন্তরিক অভ্যর্থনা ইত্যাদি।
আমার এক জার্মান বন্ধু সিলেটের এক প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে বলেছিল, “I never felt like a stranger even for a second!” আমি তখন বুঝলাম, ট্যুরিজমে শুধু জায়গা না, মানুষের আচরণই বড় একটা ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশের সংস্কৃতি, খাবার, ভাষা, উৎসব এসব কিছুই ট্রাভেলের অংশ হতে পারে। আন্তর্জাতিক পর্যটকরা এমন কিছু খোঁজেন যা তাদের চোখে নতুন, কিন্তু হৃদয়ে উষ্ণতা বা আনন্দ দেয়।
আরও: বাংলাদেশের গ্রামীণ মেলা কি হারিয়ে যেতে বসেছে?
ইতিহাস ও ঐতিহ্য
বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে ইতিহাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর, ময়নামতি, ষাটগম্বুজ মসজিদ, বাঘা মসজিদ, সোনারগাঁ, আহসান মঞ্জিল এসব শুধু পুরোনো স্থাপত্য নয়, আমাদের ইতিহাসের প্রমাণ।
এগুলোকে ঘিরে ট্যুরিজম উন্নয়ন করা গেলে শিক্ষামূলক, গবেষণাভিত্তিক কিংবা হেরিটেজ ট্যুরিজম গড়ে উঠতে পারে। ভারতের মতো দেশে তাজমহল বা বারাণসীর মতো শহরগুলো শুধু ভৌগোলিক সৌন্দর্যের জন্য নয়, ঐতিহাসিক গুরুত্বের জন্যই লাখো পর্যটক টানে।
আমরাও পারি, তবে শুধু দরকার আমাদের ইতিহাসকে গর্ব করে তুলে ধরার মানসিকতা ও উদ্যোগ। তাই না?
কম খরচে ভ্রমণের সুযোগ
বিশ্বব্যাপী অনেক মানুষ এখন বাজেট ট্যুরে বিশ্বাসী। হোস্টেল, হোমস্টে, কম খরচের লোকাল ফুড, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করে ভ্রমণ করা এখন ট্রেন্ডে। এই জায়গায় বাংলাদেশ একটা বিশাল প্লাস পয়েন্ট পেতে পারে।
আমাদের দেশে অল্প খরচেই সুন্দর ঘোরার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু সঠিক তথ্য ও গাইডলাইন না থাকায় বিদেশিরা জানে না। যদি আমরা তথ্যগুলো সঠিকভাবে অনলাইনে তুলে ধরি, ইংরেজি কনটেন্ট তৈরি করি (কুহুডাকে এটা নিয়ে আমরা প্ল্যান করছি), লোকাল গাইডদের প্রশিক্ষণ দিই, তাহলে স্বল্প বাজেটের অসংখ্য পর্যটক বাংলাদেশকে তাদের পরবর্তী গন্তব্য হিসেবে বেছে নেবে।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও লোকাল উদ্যোগের প্রসার
আমি নিজে একটা ভ্রমণ ভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম (কুহুডাক) চালাই, পাশাপাশি আছে কুহুডাকের ভ্রমণ কমিউনিটি, তাই জানি কিভাবে সাধারণ পর্যটকদের তথ্যের জন্য হন্যে হতে হয়। এখন মানুষ গুগল ঘেঁটে গন্তব্য বেছে নেয়, বুকিং করে, রিভিউ দেখে রেস্টুরেন্টে যায়।
বাংলাদেশে হাজারো সম্ভাব্য জায়গা আছে যেখানে খুব কম কনটেন্ট তৈরি হয়েছে। অথচ স্থানীয় পর্যায়ের উদ্যোগ, ব্লগ, ইউটিউব ভিডিও বা সোশ্যাল মিডিয়া প্রোমোশন দিয়ে আমরা এগুলোকে তুলে ধরতে পারি। কিন্তু যা দেখতে পাচ্ছি তা খুবই দুঃখজনক। কারন, দেশের তুলনার বিদেশের ভিডিও বানাতে কিংবা সেটা নিয়ে প্রচার করতে আমরা বিজি।
সুন্দরবন বা কক্সবাজারের বাইরে ভাবতে শিখতে হবে। আর এ কাজটা শুধু সরকারের নয়, তরুণদেরও দায়িত্ব। এখন জেনারেশন জি এর সময়। তারা চাইলে অনেক কিছুই সহজে সম্ভব।
স্থানীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব
ট্যুরিজম মানেই শুধু ছবি তোলা নয়, এটা একটা অর্থনৈতিক চেইন। একজন পর্যটক গেলে স্থানীয় রিকশাওয়ালা, দোকানদার, হোটেল মালিক, গাইড, এমনকি মাছ বিক্রেতাও উপকৃত হন। এই চেইন যত বাড়বে, তত বেশি কর্মসংস্থান হবে।
বিশ্বের অনেক দেশেই লোকাল ইকোনমির চাকা ঘোরে ট্রাভেলের মাধ্যমে। আমাদের পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে যদি লোকাল ট্রাইবাল কমিউনিটিকে যুক্ত করে ট্যুর প্রোগ্রাম করা যায়, তাহলে তারা উপকৃত হবে এবং নিজের সংস্কৃতি তুলে ধরতে পারবে। আমাদের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আমরা কুহুডাক থেকে এসব নিয়ে ভাবছি। কিভাবে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প কে এগিয়ে নেয়া যায়।
চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
স্বপ্ন দেখছি… ভালোও লাগছে, কিন্তু বাস্তবতাও স্বীকার করতে হবে। আমাদের ট্র্যাভেল ইন্ডাস্ট্রির এখনো অনেক সমস্যা আছে, অনিরাপদ সড়ক, অপরিকল্পিত উন্নয়ন, ময়লা-আবর্জনা, পর্যাপ্ত তথ্যের অভাব, পর্যটক হয়রানি, গাইডের পেশাদারিত্বের অভাব ইত্যাদি।
কিন্তু এই সমস্যাগুলো অমীমাংস্য নয়। পরিকল্পনা, শিক্ষা, টেকসই ট্যুরিজম ধারণা, স্থানীয় প্রশাসনের অংশগ্রহণ, এসবের সমন্বয়ে এগিয়ে গেলে আমরা এসব কাটিয়ে উঠতে পারব।
ব্র্যান্ডিং দরকার ‘Visit Bangladesh’ হোক বিশ্বমানের ক্যাম্পেইন
ভারত “Incredible India”, থাইল্যান্ড “Amazing Thailand”, মালয়েশিয়া “Truly Asia” -এমন ক্যাম্পেইন দিয়ে নিজেদের আন্তর্জাতিক পর্যটনের ব্র্যান্ড বানিয়েছে। বাংলাদেশও পারবে যদি আমরা “Visit Bangladesh” ধরনের পেশাদার ক্যাম্পেইন শুরু করি।
এই ক্যাম্পেইনে জায়গার সৌন্দর্য নয়, মানুষের গল্প, সংস্কৃতি, খাবার, আবেগ সবই তুলে ধরা উচিত। এক্সপেরিয়েন্স-ভিত্তিক মার্কেটিংই এখন সফল।
আমার শেষ কথা
আমি বিশ্বাস করি যে বাংলাদেশের ট্র্যাভেল ইন্ডাস্ট্রির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আছে। শুধু সরকারি বা প্রাইভেট উদ্যোগ নয়, প্রতিটি সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব আছে দেশের সৌন্দর্যকে সম্মানের চোখে দেখার, প্রচারের এবং রক্ষার।
আমি কল্পনা করি একদিন এমন একটা বাংলাদেশ, যেখানে সেন্টমার্টিনের বালি শুধু দেশি ট্যুরিস্ট নয়, বিদেশি প্রেমিক যুগলরাও উপভোগ করবে; যেখানে পানাম নগর কেবল ইতিহাস বইয়ে লিপিবদ্ধ থাকবে না, বিশ্বের টপ ১০ হেরিটেজ ট্যুরের অংশ হবে; যেখানে প্রত্যন্ত গ্রামের হোমস্টেতে রাত কাটানো হবে এক আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা।
এই স্বপ্ন শুধু আমার না—আমাদের সবার। ইনশা আল্লাহ্, আমরা পারই…
আমাকে ফেসবুকে ফলো করতে পারেন: Arif