খড়ম

৪ মিনিটে পড়া যাবে

খড়ম (Paduka) বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পাদুকার একটি বিশেষ অংশ, যা বহু শতাব্দী ধরে বাংলার সংস্কৃতি ও গ্রামীণ জীবনের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। মূলত কাঠের তৈরি এই খড়মগুলি একসময় নানা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ও সাধারণ মানুষের পরিচয়ের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সাধারণত প্রাচীনকালে পুণ্যব্রতী ব্যক্তিরা এবং কিছু সম্প্রদায়ের পুরোহিতরা খড়ম পরিধান করতেন, যা তাদের সাধুতা এবং সন্ন্যাসী জীবনের প্রতীকী হিসেবে বিবেচিত হতো।

আরও: হাল বা লাঙল

খড়ম তৈরির উপাদান ও শৈলী

খড়ম তৈরির প্রধান উপকরণ হলো কাঠ। সাধারণত নিম, মহগনি, কিংবা আমগাছের কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয় খড়ম। কাঠের টেকসই গঠন ও কাঠামোর জন্য নির্দিষ্ট কাঠের পছন্দ ছিল, যাতে এটি দীর্ঘস্থায়ী ও আরামদায়ক হয়। খড়মের মূল আকৃতি বেশ সরল হলেও এতে থাকা দুটি গোল কাঠি, যা আঙ্গুলের সাহায্যে ধরা হয়, এর একটি বিশেষ চিহ্ন। এটি পায়ের সাথে সহজে মানিয়ে যাওয়ার জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়। সাধারণত হাতে তৈরি খড়মের ওপর কাঠের সূক্ষ্ম কারুকাজও চোখে পড়ে, যা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতিফলন।

খড়ম - কুহুডাক স্মৃতি আর্কাইভ

ধর্মীয় ও আচরণগত গুরুত্ব

খড়মকে শুধু পাদুকা হিসেবে নয়, বরং ধর্মীয় জীবনযাপনের সাথে জড়িত একটি পবিত্র প্রতীক হিসেবেও দেখা হতো। বিশেষত সন্ন্যাসী ও গুরুজনদের জন্য খড়ম ছিল শ্রদ্ধা ও আনুগত্যের চিহ্ন। অনেক সাধু ও গুরুজনের পায়ে খড়ম পরার প্রচলন ছিল, যা তাদের সন্ন্যাসী জীবন এবং জাগতিক বিলাসবহুলতা পরিহারের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ভারতের বিভিন্ন মন্দিরে এখনো সাধুদের জন্য খড়ম রাখা হয়, যা ভক্তদের মাঝে এক ধরনের আধ্যাত্মিকতা ও শ্রদ্ধা তৈরি করে।

আরও: কাবাডি

গ্রামবাংলার খড়ম সংস্কৃতি

গ্রামবাংলার মানুষদের কাছে খড়ম ছিল সহজলভ্য এবং আরামদায়ক পাদুকা। বৃষ্টির দিনে মাটি ভিজে কাদায় পরিণত হলে, খড়মের কাঠের গঠন মাটি থেকে একটু উঁচুতে থাকার সুবিধা দিত, যা অন্যান্য পাদুকার চেয়ে বেশি কার্যকর প্রমাণিত হতো। একসময় গ্রামের হাট-বাজারে খড়ম বিক্রি হতো এবং প্রতিটি পরিবারের বৃদ্ধদের জন্য একজোড়া খড়ম ছিল যেন অবধারিত।

খড়ম - কুহুডাক স্মৃতি আর্কাইভ
ছবি: মনোনেশ দাস

আধুনিকতা ও বিলুপ্তি

বর্তমান যুগে খড়মের ব্যবহার ক্রমশ কমে আসছে। আধুনিক জীবনযাত্রায় বিভিন্ন ধরনের পাদুকার আবির্ভাব খড়মের স্থানে স্থান দখল করেছে। তবে বিভিন্ন মেলায় এবং ঐতিহ্যবাহী প্রদর্শনীতে এখনো খড়ম বিক্রি হয় এবং গ্রামীণ মেলার একটি আকর্ষণীয় উপাদান হিসেবে এর চাহিদা বজায় রয়েছে। কিছু উদ্যোগপতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণকারীরা খড়মকে আবারও জনপ্রিয় করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন, যাতে নতুন প্রজন্ম বাংলার এই অনন্য ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারে।

খড়ম - কুহুডাক স্মৃতি আর্কাইভ

লোককথা

বাংলার গ্রামাঞ্চলে খড়ম নিয়ে বিভিন্ন লোককথা প্রচলিত আছে। অনেক গল্পে খড়মকে ঐশ্বরিক ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কথিত আছে, সাধু-সন্ন্যাসীরা খড়ম পায়ে রাখলে নানা অলৌকিক ক্ষমতা লাভ করতেন। কোনো কোনো অঞ্চলে বিশ্বাস করা হয়, গুরুজনদের খড়ম ঘরে রাখা হলে পরিবারের সদস্যদের সুরক্ষা এবং সৌভাগ্য বৃদ্ধি পায়। এ ধরনের লোককথা খড়মকে শুধু একটি পাদুকা নয়, বরং আধ্যাত্মিকতার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরে, যা বাংলার সংস্কৃতিতে এক অনন্য মাত্রা যোগ করে।

খড়ম নিয়ে লোকজ ছড়া:

হরম বিবি খড়ম পায়
খটটাইয়া হাঁইটা যায়
হাঁটতে গিয়া হরম বিবি
ধুম্মুড় কইরা আছাড় খায়
আছাড় খাইয়া হরম বিবি
ফিরা ফিরা পিছন চায় ….

খড়ম বাংলা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা কেবলমাত্র পাদুকা নয় বরং একসময়কার জীবনযাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। গ্রামবাংলার মানুষের জীবনে এই কাঠের পাদুকার যে ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব ছিল, তা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ঐতিহ্যবাহী জীবনধারার প্রতি ভালোবাসা এবং সম্মানের।

- বিজ্ঞাপন -
বিজ্ঞাপন দিন - কুহুডাকবিজ্ঞাপন দিন - কুহুডাক

ফেসবুক: কুহুডাক

শেয়ার করুন
মন্তব্য করুন

মন্তব্য করুন

Kuhudak (কুহুডাক) LogoKuhudak (কুহুডাক) Logo

আপনার আশেপাশের দর্শনীয় স্থানের তথ্য দিন

কুহুডাকে আপনার আশেপাশের দর্শনীয় স্থানের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করুন।