টাঙ্গুয়ার হাওর (Tanguar Haor) বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যনগর ও তাহিরপুর উপজেলার মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত একটি মিঠাপানির হাওর। বাংলাদেশের ২য় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি/হাওর প্রায় ১২৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে!
আজকের পোস্টে আমরা সুনামগঞ্জ (Sunamganj) জেলার টাঙ্গুয়ার হাওর সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব। সাথে একটি ছোট ভ্রমণ প্ল্যান ও খরচের হিসেব থাকবে। চলুন শুরু করা যাক…
আরও: নিকলী হাওর
টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ
ভ্রমণ স্থান | টাঙ্গুয়ার হাওর |
অন্য নাম | নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল |
ধরন | দর্শনীয় স্থান, হাওর |
অবস্থান | সুনামগঞ্জ, সিলেট, বাংলাদেশ |
আয়তন | ১২৬ বর্গকিলোমিটার (প্রায়) |
পানির আয়তন | ১২,৬৫৫ হেক্টর (৩১,২৭১.১৯ একর) |
আখ্যা | মাদার অব ফিশারিজ সব হাওরের মা |
ঢাকা থেকে দূরত্ব | প্রায় ৩০০ কিলোমিটার |
সিলেট শহর থেকে দূরত্ব | প্রায় ১০৭ কিলোমিটার |
ড্রোন উড়ানো যাবে | হ্যাঁ |
ভ্রমণের উপযুক্ত সময় | বর্ষাকাল |
টাঙ্গুয়ার হাওরের যেদিকে তাকাবেন শুধু অথৈ পানি দেখতে পাবেন। এছাড়া রয়েছে জলাবন, নীল আকাশ, পাহাড় ও চোখ জুড়ানোর মত সবুজ যা এই হাওরকে অপরুপ সুন্দর করে সাজিয়েছে।
টাঙ্গুয়ার হাওরকে মাদার অব ফিশারিজ বা সব হাওরের মা বলে অবহিত করা হয়ে থাকে। তবে, স্থানীয় লোকজনের কাছে হাওরটি নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল নামেও পরিচিতি রয়েছে। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার স্থান হিসাবে পরিচিত, প্রথমটি হচ্ছে সুন্দরবন।
আরও: জাফলং
কি আছে টাঙ্গুয়ার হাওরে
টাঙ্গুয়ার হাওরের মোট আয়তন প্রায় ১২৬ বর্গকিলোমিটার যেখানে ১২,৬৫৫ হেক্টর (৩১,২৭১.১৯ একর) বিস্তৃত পানি রয়েছে! এছাড়া বর্ষার মৌসুমে এই আয়তন আরও বেশি হতে পারে। হাওরে প্রায় ১৪০ প্রজাতির ছোট-বড় মাছ রয়েছে। এছাড়া ১২ প্রজাতির ব্যাঙ এবং ১৫০ প্রজাতির বেশি সরীসৃপের সমন্বয়ে জীববৈচিত্র্য গড়ে উঠেছে এই হাওরে।
আপনি এখানে ভ্রমণে হাওরে নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারবেন। এছাড়া, শীতকালে ভ্রমণে গেলে প্রায় ২৫০ প্রজাতির অতিথি পাখির দেখা পাবেন। তবে টাঙ্গুয়ার হাওর বর্ষাকালে ভ্রমণে গেলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন।
হাওড় ভ্রমণে আপনি টাঙ্গুয়ার থেকে ভারতের মেঘালয়ের পাহারগুলোর দেখা পাবেন এছাড়া প্রায় ৩০টির মত ছোট-বড় ঝর্ণা বা ছড়া দেখতে পাবেন। হাওরে একটি ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে।
হাওরের পানি খুবই স্বচ্ছ। আপনি পানির নিচে কি রয়েছে তা পরিষ্কার ভাবে দেখতে পাবেন। ভ্রমণে এখানে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৮৮ টির মত দ্বীপ বা ভাসমান গ্রাম অথবা দ্বীপ গ্রাম দেখতে পাবেন। এখানের মানুষের হাওরের সাথেই বসবাস। তাদের প্রধান আয়ের উৎস হচ্ছে এই হাওড়ের মাছ।
১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকার টাঙ্গুয়ার হাওরকে পরিবেশগতভাবে সংকটজনক এলাকা বা বাস্তুসঙ্কটাপন্ন এলাকা বা Ecologically Critical Area (ECA) হিসেবে ঘোষণা করে। এছাড়া ২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি টাঙ্গুয়ার হাওর রামসার সাইট (Ramsar site) এর তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
বর্ষাকালে এখানে ভরপুর পানি থাকলেও শীত মৌসুমে হাওড়ের পানি শুকিয়ে প্রায় ২৪টি বিলের পাড় (স্থানীয় ভাষায় কান্দা) জেগে উঠে। কান্দার আদি বিলে শুকিয়ে যাওয়া অংশে স্থানীয় কৃষকেরা রবিশস্য ও বোরো ধানের আবাদ করেন থাকেন। এছাড়া গরু বা গোচারণভূমি হিসেবেও এই চর ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
আরও: বিছনাকান্দি
হাওরের জীববৈচিত্র্য
টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্যের মধ্যে অন্যতম বিভিন্ন জাতের পাখি। এছাড়া সরীসৃপ ও উভচর, মৎস্যসম্পদ ও নানা প্রকারের উদ্ভিদবৈচিত্র্য দেখা মিলে।
পাখি
টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণে আপনি সবচেয়ে বেশি বিভিন্ন জাতের পাখির দেখা পাবেন। স্থানীয় জাতের পাখির পাশাপাশি আপনি শীতকালে ভ্রমণে গেলে, সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আগত পরিযায়ী পাখি দেখা পাবেন। পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে বিরল প্রজাতির প্যালাসেস ঈগল, বড় আকারের গ্রে কিংস্টর্কের দেখা পাবেন।
২০১৯ সালের পাখিশুমারি অনুযায়ী হাওর ও এর আশপাশের এলাকায় প্রায় ২০৮ প্রজাতির পাখি দেখা মিলেছে। স্থানীয় জাতের পাখিদের মধ্যে শকুন, পানকৌড়ি, বেগুনি কালেম, ডাহুক, বালিহাঁস, গাঙচিল, বক, সারস, কাক, শঙ্খ চিল, পাতি কুট ইত্যাদি জাতের পাখির নিয়মিত বিচরণ রয়েছে।
এছাড়া ২০১১ সালে পাখিশুমারিতে এই হাওরে চটাইন্নার বিল ও তার খাল, রোয়া বিল, লেচুয়ামারা বিল, রুপাবই বিল, হাতির গাতা বিল, বেরবেরিয়া বিল, বাইল্লার ডুবি, তেকুন্না ও আন্না বিলে প্রায় ৪৭ প্রজাতির জলচর পাখি বা ওয়াটারফাউলের মোট ২৮,৮৭৬টিরও বেশি পাখি গণনা করা হয়েছিল! আপনি জানেন কি? বাংলাদেশে দৃশ্যমান ৮টি বেয়ারের ভুঁতিহাসের মধ্যে ৫টিই পাওয়া গেছে টাঙ্গুয়ার হাওরে!
সরীসৃপ ও উভচর
টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রায় ৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ২০ প্রজাতির সাপ, বিরল প্রজাতির উভচর, ৪ প্রজাতির কচ্ছপ ও ৭ প্রজাতির গিরগিটিসহ নানাবিধ প্রাণীর আবাস রয়েছে।
এখানে আপনি বিলুপ্ত কাছিমের মধ্যে রয়েছে হলুদ কাছিম, কড়ি কাইট্টা ও পুরা কাইট্টার দেখা পাবেন। তবে বর্তমানে এখানে জাত কাছিম ও ধুম কাছিম বেশি দেখা যাচ্ছে। এছাড়া রয়েছে ঝিঁঝিঁ ব্যাং ও সারসারি ব্যাং। সাপের মধ্যে রয়েছে জালবোরা, কোবরার ২টি জাত ও দাঁড়াইশ সাপ।
মৎস্যসম্পদ
হাওরে প্রায় ২০০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। হাওরের বিখ্যাত মাছের মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে মহাশোল মাছ। এছাড়া এখানে ছোট-বড় নানা প্রকার এবং নানা জাতের মাছ পাওয়া যায়। ভ্রমণে গেলে হাওড়ের মাছ খেয়ে আসতে ভুলবেন না কিন্তু।
উদ্ভিদবৈচিত্র্য
টাঙ্গুয়ার হাওরের উদ্ভিদ বা গাছগাছালির মধ্যে রয়েছে হিজল, করচ, বরুণ, পানিফল, হেলেঞ্চা, বনতুলসী, নলখাগড়া, বল্লুয়া, চাল্লিয়া, সিংড়া, শালুক, শাপলা, গুইজ্জাকাঁটা, উকল ইত্যাদি। এছাড়া আপনি আরও নানা জাতের ছোট-বড় গাছের দেখা পাবেন।
আরও: পান্থুমাই ঝর্ণা
ভ্রমণের উপযুক্ত সময়
টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের উপযুক্ত সময় হচ্ছে, বর্ষাকাল। বর্ষাকালে এখানে ভ্রমণে গেলে বেশি উপভোগ করতে পারবেন। আপনার যদি পানিতে নৌকা ভ্রমণ করতে ভালো লাগে তাহলে টাঙ্গুয়ার হাওর অথবা নিকলী হাওর ভ্রমণে যেতে পারেন।
আপনার যদি পানিতে ভয় লাগে তাহলে শীতকালে ভ্রমণে যেতে পারেন। কারন, এসময় হাওর পানি কম থাকে এবং শীতকালে প্রচুর অতিথি পাখির দেখা মিলে। এছাড়া বছরের অন্য সময় সাধারণত এর পানি অনেক কম থাকে। চাইলে সে সময় গুলতেও যেতে পারেন। তবে, পর্যটকদের বেশি আনাগোনা দেখা যায় বর্ষার মৌসুমে।
আরও: শ্রীমঙ্গল
কীভাবে যাবেন
বাংলাদেশের যে কোন স্থান থেকে আপনি টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণে যেতে পারেন। রাজধানী ঢাকা, সিলেট এবং সুনামগঞ্জ থেকে কিভাবে ভ্রমণে যাবেন তা নিচে দেয়া হল-
ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ ভ্রমণ
রাজধানী ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ ভ্রমণ যেতে চাইলে ঢাকার সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে নন-এসি মামুন ও শ্যামলী পরিবহণের বাস সরাসরি সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় আর মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে নন-এসি এনা পরিবহণের বাস সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। আর ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ যেতে সময় লাগে প্রায় ৬ ঘন্টার মত।
ভাড়া: জনপ্রতি বাসের টিকেট মূল্য ৮৫০ টাকা থেকে ১,০০০ টাকা নিতে পারে।
সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ ভ্রমণ
আপনি চাইলে সিলেট শহর থেকে সুনামগঞ্জ ভ্রমণে যেতে পারেন। সিলেট শহরের কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ড থেকে সুনামগঞ্জ যাবার লোকাল ও সিটিং বাস সার্ভিস রয়েছে। সুনামগঞ্জ যেতে সময় লাগবে ২ ঘন্টার মত।
ভাড়া: সিটিং বাস ভাড়া জনপ্রতি ১০০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা নিতে পারে।
বি:দ্র: আপনি শাহজালাল মাজারের সামনে থেকে লাইট গাড়িতে ২০০ টাকা ভাড়ায় সুনামগঞ্জ যেতে পারবেন।
সুনামগঞ্জ থেকে টাংগুয়া
সুনামগঞ্জ নেমে সুরমা নদীর উপর নির্মিত বড় ব্রীজের কাছে লেগুনা বা CNG অথবা মোটরবাইকে সহজেই তাহিরপুরে চলে আসবেন। তাহিরপুরে নৌকা ঘাট থেকে সাইজ এবং আপনার বা আপনাদের সামর্থ অনুযায়ী নৌকা ভাড়া করে বেড়িয়ে আসুন টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে। নৌকা ভাড়া করার সময় অবশ্যই দামাদামি করে নিবেন।
তবে মনে রাখবেন যে, শীতকালে হাওরের পানি কমে যায় বলে আপনাকে লেগুনা বা সিএনজি অথবা মোটরবাইক যোগে যেতে হবে সোলেমানপুর। সোলেমানপুর থেকে নৌকা ভাড়া করে হাওড় ঘুরে দেখতে পারেন। শীতকালে ভ্রমণে গেলে আপনি অতিথি পাখির দেখা পাবেন।
বি:দ্র: আপনি চাইলে ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমানে করে সিলেট যেতে পারেন। যেকোনো ডোমেস্টিক এবং আন্তর্জাতিক গন্তব্যে সস্তায় বিমানের টিকিট কাটুন কুহুডাক এয়ার থেকে।
আরও: গ্রীনল্যান্ড পার্ক
হাউসবোট/নৌকা ভাড়া
আসুন এবার হাউসবোট বা নৌকা ভাড়া নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক। হাওরে নৌকা ভাড়া করার সময় কিছু বিষয়ের উপর লক্ষ্য রাখুন। যেমন, নৌকায় বাথরুমের ব্যবস্থা আছে কিনা, সোলার প্যানেলের মাধ্যমে মোবাইল চার্জ দেওয়া যাবে কিনা। এছাড়াও, লাইট ও ফ্যানের ব্যবস্থা ব্যবস্থা রয়েছে কিনা তা আগেই জেনে নিন।
এখানে নৌকা ভাড়া মূলত ৩টি বিষয়ের উপর নির্ভর করে থাকে। ছোট নৌকা গুলো আপনি ১৫০০ টাকা থেকে ২,০০০ টাকার মধ্যে ভাড়া করতে পারবেন। আর মাঝারি নৌকার ক্ষেত্রে ২২০০ টাকা থেকে ৩৫০০ টাকা এবং বড় নৌকা ৩৫০০ থেকে ৬৫০০ টাকায় সারাদিনের জন্য ভাড়া করতে পারবেন।
আপনি বা আপনারা যদি ১ রাত নৌকায় কাটাতে চান তাহলে ছোট নৌকা ৩৫০০ টাকা থেকে ৫,০০০ টাকা এবং বড় নৌকা ৭,০০০ টাকা থেকে ১০,০০০ টাকার মধ্যে ভাড়া করতে পারবেন। যদি নৌকায় সোলার প্যানেল ও লাইফ জ্যাকেটের ব্যবস্থা না থাকলে তাহিরপুর বাজার থেকে আইপিএস ও লাইফ জ্যাকেট ভাড়া করে নিতে পারবেন।
আপনাদের খাওয়ার রান্নার জন্য নৌকার মাঝিকে খরচের টাকা দিলে সে বাবুর্চি নিয়ে যাবে অথবা চাইলে আপনারা নিজেরাই রান্না করে খেতে পারেন। আপনারা হাওরে যে প্ল্যান করবেন তা আগেই মাঝির সাথে আলোচনা করে ঠিক করে নিতে পারেন। আর যে কোন কিছু ভাড়া করার পূর্বে অবশ্যই দরদাম করে নিবেন।
আরও: মাধবপুর লেক
কোথায় খাবেন
ভ্রমণে অবশ্যই সাথে খাবার পানি রাখবেন। আর হাওড় ভ্রমণে গিয়ে খাওয়ার জন্য ২টি উপায় রয়েছে।
প্রথমটি হল, আপনি যদি একদিনের ভ্রমণে যান তাহলে সকালে ভ্রমণের সময় তাহিরপুরের খাবার হোটেল থেকে খেয়ে নিতে পারেন। আবার ভ্রমণ শেষে তাহিরপুরে ফিরে খাবার খেতে পারেন। খাবারের সময় খেয়াল রাখবেন যে, এখানে হাওড়ের প্রায় ২০ থেকে ২৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। আপনার পছন্দ অনুযায়ী যে কোন মাছ দিয়ে খেয়ে নিতে পারেন।
দ্বিতীয় উপায় হল, আপনি যদি ভ্রমণে গিয়ে রাতে নৌকা ভাড়া করে থাকতে চান তাহলে নিজেরা রান্না করে খেতে পারেন। নিজেরা রান্না করে খাওয়ার জন্য তাহিরপুর থেকে নৌকায় উঠার আগে যে কয়দিন অবস্থান করবেন সেই কয়দিনের বাজার করে নিতে পারেন। আর নিজেরা রান্না করার ঝামেলা এড়াতে চাইলে টেকেরঘাট রাত্রি যাপন করলে সেখানে টেকেরঘাট বাজার থেকে রাতের খাবার খেয়ে নিতে পারবেন।
আরও: বাংলাদেশের ৬৪ জেলার বিখ্যাত খাবারের তালিকা
কোথায় থাকবেন
আপনি বা আপনারা যদি একদিনের ভ্রমণে যান তাহলে তো থাকার প্রশ্ন আসে না তবে যদি থাকতে চান তাহলে টাঙ্গুয়ার হাওরে নৌকায় থাকা ছাড়া হাওরে থাকার জন্য তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। আর যদি নৌকায় রাত কাটাতে চান তাহলে নিরাপত্তার জন্যে পাড়ের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করবেন।
এছাড়া আপনারা যদি ঘর ভাড়া করতে চান তাহলে টেকেরঘাট এলাকায় হাওর বিলাশ নামে কাঠের বাড়িতে সল্প মূল্যে রুম ভাড়া নিয়ে থাকতে পারবেন। তবে সাহস করে টাঙ্গুয়ার হাওরে নৌকায় এক রাত থাকার অভিজ্ঞতা নিলে অবশ্যই আপনাদের ভাল লাগবে।
২ দিন ১ রাতের ট্যুর প্ল্যান
আপনি বা আপনারা চাইলে হাওরে ২ দিন ১ রাতের ট্যুর প্ল্যান করতে পারেন। বর্ষাকালে ২ দিন ১ রাতের ট্যুর প্ল্যান কে আদর্শ ট্যুর প্ল্যান বলা হয়ে থাকে। চলুন নিচে ২ দিন ১ রাতের ট্যুর প্ল্যান সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাক…
বর্ষাকালে অথবা আপনাদের সুবিধামত যেকোন দিন রাতের বাসে করে সুনামগঞ্জ চলে যাবেন। সুনামগঞ্জ সকাল ৭ টার মধ্যে পৌছে নাস্তা করে নিবেন। এরপর সিএনজি ভাড়া করে তাহিরপুর চলে আসবেন। সময় লাগবে ১ ঘন্টার মত। ঘাট থেকে নৌকা ভাড়া করে নৌকায় ওঠার আগে ২ দিন ১ রাতের জন্য মাছ, মাংস ও অন্য প্রয়োজনীয় বাজার করে নিবেন।
চেষ্টা করুন সকাল ৯ থেকে ১০ টার মধ্যে নৌকায় যাত্রা শুরু করার। নৌকা নিয়ে সোজা চলে আসুন ওয়াচ টাওয়ার এলাকায়। ওয়াচ টাওয়ার এলাকায় জলাবনের সৌন্দর্য্যের পাশাপাশি ছোট ছোট নৌকা নিয়ে ছোট বাচ্চাদের ঘুরতে দেখবেন। চাইলে ওয়াচ টাওয়ারে রান্নার কাজ করে ফেলতে পারেন।
আপনাদের ওয়াচ টাওয়ার দেখা শেষ হলে চলে যেতে পারেন হাওরের একেবারে মাঝখানে। চারদিকে জলরাশি দেখে দুপুরের পর পরই টেকেরঘাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবেন। এই দিকে নৌকা যতই এগুতে থাকবে ততই পানি স্বচ্ছ হতে হতে এক সময় পানি এতই স্বচ্ছ দেখাবে যে আপনি হাওরের তলা পর্যন্ত দেখতে পারবেন।
আপনি যদি হাওরে গোসল না করে থাকেন তাহলে টেকেরঘাটের নীলাদ্রি লেকে এসে গোসল সেরে নিতে পারেন। আর এখানেই হাওরে নৌকা বেধে নৌকার মধ্যে রাত কাটিয়ে দিতে পারেন। প্রথম দিনের ভ্রমণে এখানেই শেষ।
পরদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে যাদুকাটা নদী ও বারিক্কাটিলা দেখতে রওনা দিবেন। চাইলে টেকেরঘাট থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে যেতে পারবেন। তবে নৌকা নিয়ে যাওয়া যায় কিন্তু একটু দূর হওয়ায় মাঝি আপত্তি করতে পারে অথবা আপনাদের থেকে আরও ২,০০০ টাকা থেকে ৪,০০০ টাকা অতিরিক্ত চাইতে পারে। তাই সবচেয়ে ভালো উপায় হলো তাহিরপুর ঘাট থেকে নৌকা ভাড়া করার সময় মাঝিকে যাদুকাটা নিয়ে যাবার কথা বলে নৌকা ঠিক করা।
যে কোন উপায়ে যাদুকাটা নদী ও বারিক্কাটিলা দেখে দুপুরের মধ্যে টেকেরঘাট ফিরে আসবেন। টেকেরঘাটে হাওর ঘুরে সন্ধ্যার আগেই তাহিরপুর চলে আসবেন। চাইলে, তাহিরপুর থেকে CNG ভাড়া করে অথবা লোকাল লেগুনাতে সরাসরি সুনামগঞ্জ চলে আসবেন। তারপর বাড়ি যাওয়ার পালা।
আরও: সিলেট বিভাগের দর্শনীয় স্থান সমূহ
ভ্রমণ খরচ
আপনাদের ২ দিন ১ রাতের ট্যুর প্ল্যানে কি রকম খরচ হতে পারে তার একটা ধারণা দেয়া হল। যদি আপনারা ১০ জনের একটি দল ২ দিন ১ রাত টাঙ্গুয়ার হাওর থাকতে চান তাহলে খরচ হবে-
- ঢাকা থেকে বাসে আসা যাওয়ার ভাড়া জনপ্রতি: ১১০০ টাকা।
- ২ দিন ১ রাতের নৌকা ভাড়া: ৫,০০০ টাকা থেকে ১০,০০০ টাকা।
- দুই দিন নাস্তার জন্য জনপ্রতি খরচ: ১০০ টাকা।
- প্রতিবেলা ২০০ টাকা ধরে ২দিনের জনপ্রতি ৪ বেলার খাবার খরচ: ৮০০ টাকা।
- তাহিরপুর যাওয়া ও আসার জনপ্রতি খরচ: ২০০ টাকা।
- তাহিরপুর থেকে বাস স্টান্ডে আসার জনপ্রতি খরচ: ২০ টাকা।
- অন্যান্য খরচ জনপ্রতি ২০০ টাকা।
টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ টিপস ও সতর্কতা
টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের টিপস ও সতর্কতা দেয়া হলো। আশাকরি নিচের পরামর্শ গুলো মেনে চললে আপনার ভ্রমণ হবে নিরাপদ এবং আনন্দময়।
- যাদের পানিতে ভয় (Water Phobia) রয়েছে তারা হাওর ভ্রমণের সময় অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করুন। কারন এটা হাওর। চারপাশে শুধু পানি আর পানি।
- বর্ষার মৌসুমে প্রচুর ভ্রমণ প্রেমীরা এখানে ঘুরতে যান। ভ্রমণের আগে বৃষ্টির কথা মাথায় রেখে পোশাক নিয়ে নিবেন।
- হাওর ভ্রমণকালে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট সাথে নিবেন। যারা সাতার পারেন না তারা লাইফ জ্যাকেট নিয়ে পানিতে নামবেন।
- যেখানে পানির গভীরতা বেশী সেখানে নামার সময় সাবধান থাকুন।
- চাইলে, হাওরে রওনা হবার আগে তাহিরপুরে থানায় আপনার নিরাপত্তার জন্যে জিডি করে নিতে পারেন।
- রাতে থাকতে চাইলে সাথে অতিরিক্ত পোশাক নিয়ে নিন।
- যে কোন কিছুর জন্যে দামাদামি করে নিতে ভুলবেন না।
- নৌকায় উঠার আগে হালকা খবার এবং পানি নিয়ে নিন।
- একসাথে গ্রুপ করে গেলে খরচ কম হবে তাই ৪ থেকে৫ জন অথবা ৮ থেকে ১০ জনের গ্রুপ করে গেলে ভালো হবে।
- মোবাইল, মানিব্যাগ, ক্যামেরা, ড্রোন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস সাবধানে রাখুন।
- হাওরে বজ্রপাত হলে নৌকার ছৈয়ের নিচে অবস্থান করুন।
- সাথে বাচ্চা থাকলে, বাচ্চাদের প্রতি অতিরিক্ত খেয়াল রাখুন।
- খাবারের অতিরিক্ত অংশ/উচ্ছিষ্ট, প্যাকেট, ময়লা ইত্যাদি হাওরের পানিতে ফেলা থেকে নিজেকে বিরত থাকুন।
- কারও সাথে খারাপ ব্যাবহার করবেন না।
- উচ্চ শব্দ সৃষ্টিকারী মাইক বা যন্ত্র পরিহার করুন।
- নৌকার উঠে লাফালাফি করবেন না।
- রাতের বেলা অতিরিক্ত উজ্জ্বল আলো উৎপন্ন করবেন না।
- হাওরের পানি পান করবেন না। সাথে প্রয়োজনীয় খাবার পানি নিয়ে নিবেন।
- টাংগুয়ার মাছ, বন্যপ্রাণী কিংবা পাখি ধরা বা এদের জীবন হুমকির মধ্যে পড়ে এমন যে কোন কাজ থেকে নিজেকে বিরিত থাকুন।
- ভ্রমণে সাথে করে টর্চ ব্যাকআপ ব্যাটারিসহ, পাওয়ার ব্যাংক, ক্যাম্পিং মগ, চাদর, রেইনকোর্ট বা ছাতা, নিয়মতি সেবনীয় ওষুধ, টয়লেট পেপার, ব্যাগ ঢেকে ফেলার মতো বড় পলিথিন, প্লাস্টিকের স্যান্ডেল (চামড়ার স্যান্ডেল পরিহার করা ভাল হবে), সানগ্লাস, ক্যাপ বা হ্যাট, গামছা (যা সহজে শুকাবে), প্রয়োজনীয় খাবার পানি, হাফ প্যান্ট এবং সহজে শুকায় এমন জামাকাপড় রাখার চেষ্টা করুন।
ভ্রমণ জিজ্ঞাসা
হাওড় ভ্রমণে সাধারণ কিছু প্রশ্ন-উত্তর বা ভ্রমণ জিজ্ঞাসা। এরপরও যদি আপনার কোন বিষয়ে জিজ্ঞাসা থাকে তাহলে কমেন্টে জানাতে পারেন অথবা আমাদের ফেসবুক পেজে কিংবা হোয়াটসঅ্যাপে জানাতে পারেন।
টাঙ্গুয়ার হাওর কততম ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ?
টাঙ্গুয়ার হাওর ২য় হেরিটেজ। আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষিত বাংলাদেশের ২য় ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ রামসার সাইট’।
টাঙ্গুয়ার হাওর কোন জেলায় অবস্থিত?
টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলায় অবস্থিত।
টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের উপযুক্ত সময় কখন?
টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের উপযুক্ত সময় হচ্ছে, বর্ষাকাল। বর্ষাকালে এখানে ভ্রমণে গেলে বেশি উপভোগ করতে পারবেন।
আপনার ভ্রমণ হউক নিরাপদ এবং আনন্দময়।
ফেসবুক: কুহুডাক