সদরঘাট (Sadarghat) বা সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী নদীবন্দর এবং সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল। এটি শুধু ঢাকা শহরের জন্য নয়, বরং দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার সঙ্গে যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। যদিও পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পরে সদরঘাটের কার্যকারিতা কিছুটা কমে গেছে, তবুও আজও এটি দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলাগুলোর জন্য অপরিহার্য।
আজকের কুহুডাকের পোস্টে আমরা ঐতিহ্যবাহী নদীবন্দর ঢাকার সদরঘাট সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব এবং কি দেখবেন, কিভাবে যাবেন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। চলুন শুরু করা যাক…
আরও: লালবাগ কেল্লা
সদরঘাট নদীবন্দর
স্থান | সদরঘাট |
ধরন | নদীবন্দর, লঞ্চ টার্মিনাল |
অবস্থান | ঢাকা, বাংলাদেশ |
চালু | ১৭ শ শতাব্দী |
মালিক | বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষ |
সদরঘাটের গুরুত্ব
সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে দেশের প্রায় ৪৫টি রুটে লঞ্চ ও স্টিমার চলাচল করে। এর মধ্যে পটুয়াখালী, বরিশাল, বরগুনা, ভোলা, ঝালকাঠি, মাদারীপুর, চাঁদপুর, খুলনা, হাতিয়া এবং বাগেরহাটের মতো গুরুত্বপূর্ণ জেলাগুলো উল্লেখযোগ্য। প্রতিদিন শত শত যাত্রী এই নদীবন্দর থেকে দক্ষিণাঞ্চলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
সদরঘাটে ব্যস্ত সময়ে লঞ্চ ও স্টিমারের কোলাহল এক আলাদা পরিবেশ তৈরি করে, যা ঢাকার নৌযাত্রার ঐতিহ্যকে আজও স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে বর্তমানে পদ্মা সেতু হওয়ার পর লঞ্চে ভ্রমণের সংখ্যা অনেক কমে গেছে।
ইতিহাস
সদরঘাটের প্রতিষ্ঠার সঠিক সময় সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া না গেলেও এটি প্রায় এক হাজার বছরের পুরোনো বলে মনে করা হয়। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গড়ে ওঠা ঢাকা শহরের ইতিহাসের সঙ্গেই সদরঘাটের ইতিহাস অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
ঢাকার প্রাচীন ইতিহাসে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। বুড়িগঙ্গা নদীকে ঘিরে এই অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য, সামরিক কার্যক্রম এবং প্রশাসনিক কার্যাবলি পরিচালিত হতো। বুড়িগঙ্গা নদীর উল্লেখ পাওয়া যায় দুই হাজার বছর আগে রচিত ‘কলিকা পুরাণ’-এ। আকবরনামা ও আইন-ই-আকবরী গ্রন্থেও ঢাকার উল্লেখ রয়েছে।
ঢাকার কেন্দ্রস্থলে বুড়িগঙ্গা নদীর অবস্থান এবং এর মাধ্যমে সারাদেশের সঙ্গে নৌ-যোগাযোগ সহজ হওয়ার কারণে এটি ছিল প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্যের জন্য আদর্শ স্থান। তৎকালীন নগর পরিকল্পনায় নদীই ছিল সকল কর্মকাণ্ডের মূল কেন্দ্রবিন্দু। এই কারণেই ঢাকা শহর নদীকেন্দ্রিক একটি নগর হিসেবে গড়ে ওঠে। সদরঘাট সেই ঐতিহ্যেরই ধারক এবং বাহক।
আরও: বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ
পদ্মা সেতু পরবর্তী সময়ে সদরঘাট
পদ্মা সেতুর নির্মাণের ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সড়ক যোগাযোগ অনেক সহজ ও দ্রুত হয়েছে। এর ফলে সদরঘাটের কার্যক্রমে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। তবে নদীপথে ভ্রমণ এখনও তুলনামূলক সস্তা এবং আরামদায়ক হওয়ায় সদরঘাট আজও যাত্রী এবং পণ্য পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
কি আছে সদরঘাটে?
সদরঘাট বাংলাদেশের অন্যতম ব্যস্ত এবং আকর্ষণীয় নদীবন্দর। এখানে যাওয়ার পর আপনি এক ভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা পাবেন।
বৃহৎ নৌযান দেখার সুযোগ
সদরঘাটে দেশের সবচেয়ে বড় এবং সুন্দর নৌযানগুলোর দেখা পাবেন আপনি। প্রতিদিন শত শত লঞ্চ, স্টিমার এবং কার্গো জাহাজ এখান থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাত্রা করে। বিশাল নৌযানগুলোর চলাচল এবং ঘাটের ব্যস্ততা দেখে এক অন্যরকম অনুভূতি হবে।
বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকা ভ্রমণ
সদরঘাট থেকে নৌকায় বুড়িগঙ্গা নদীতে ভ্রমণের সুযোগ রয়েছে। নদীর পাড়ে বসে বা নৌকায় চড়ে বুড়িগঙ্গার সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। এই ছোট্ট নৌকা ভ্রমণ আপনাকে ঢাকা শহরের কোলাহল থেকে মুক্তি দিয়ে এক শান্তিময় অভিজ্ঞতা দেবে। যদিও বুড়িগঙ্গা নদীর পানি অপরিষ্কার।
আহসান মঞ্জিল দর্শন
সদরঘাটের কাছেই অবস্থিত ঐতিহাসিক আহসান মঞ্জিল, যা পুরান ঢাকার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। সময় হাতে থাকলে এই প্রাসাদটি ঘুরে দেখতে পারেন। এটি বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক জীবন্ত নিদর্শন।
সদরঘাটের এসব অভিজ্ঞতা আপনাকে প্রকৃতি, ঐতিহ্য এবং শহুরে জীবনের এক মিশ্র স্বাদ এনে দেবে। এটি শুধু একটি নদীবন্দর নয়, বরং ইতিহাস এবং জীবন্ত কোলাহলের এক অভূতপূর্ব স্থান।
কিভাবে যাবেন
বাংলাদেশের যে কোন স্থান থেকে আপনি বাসে কিংবা লঞ্চে করে সদরঘাট আসতে পারেন। সদরঘাট, ঢাকা শহরের পুরান ঢাকায় বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। বাসে আসলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে এসে রিক্সায় বা পায়ে হেটে সদরঘাট যেতে পারেন।
এছাড়া ব্যাক্তিগত গাড়ি কিংবা সিএনজিতে অথবা মেট্রো রেলে করে বা চাইলে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে রিক্সা নিয়ে সদরঘাট আসতে পারেন।
কোথায় খাবেন
সদরঘাটে ভ্রমণের সময় আশপাশে খাওয়ার জন্য নানা ধরনের ছোট-বড় দোকান এবং রেস্টুরেন্ট পাবেন। সদরঘাটের সামনেই কিছু ছোট খাবারের দোকান আছে, যেখানে চটপটি, ফুচকা এবং হালিমের মতো স্থানীয় স্ট্রিট ফুড পাওয়া যায়। যদি আপনি পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্বাদ নিতে চান, তবে কাছাকাছি লক্ষীবাজার, নারিন্দা বা নাজিরা বাজারে যেতে পারেন। এই এলাকাগুলোতে কাচ্চি বিরিয়ানি, মুরগ পোলাও এবং মোগলাই পরোটার মতো জনপ্রিয় খাবার পাওয়া যায়।
অতিরিক্ত মানসম্মত খাবারের জন্য জনসন রোডের হোটেল স্টার এবং বাংলাবাজারের নিউ ক্যাফে কর্ণার খুবই পরিচিত। আপনি যদি একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবেশে খেতে চান, তবে বিউটি বোর্ডিং হতে পারে সেরা পছন্দ। এছাড়া, যদি বাজেট নিয়ে চিন্তা না থাকে, তাহলে বুড়িগঙ্গা Riverview Restaurant-এ খেতে পারেন। এখান থেকে বুড়িগঙ্গার সৌন্দর্য এবং সদরঘাটের ব্যস্ততা উপভোগ করার সুযোগ পাবেন।
আরও: বাংলাদেশের ৬৪ জেলার বিখ্যাত খাবারের তালিকা
সদরঘাট নিয়ে ভ্রমণ জিজ্ঞাসা
সদরঘাটে যাওয়ার সেরা সময় কখন?
সদরঘাটে যাওয়ার জন্য ভোর বা সন্ধ্যার সময়টা সবচেয়ে উপযুক্ত। ভোরে লঞ্চ ছাড়ার সময়ের ব্যস্ততা এবং বুড়িগঙ্গার সূর্যোদয়ের দৃশ্য দেখতে দারুণ অভিজ্ঞতা হবে আপনার। সন্ধ্যায় নদীর পাড়ে আলোর খেলা এবং লঞ্চের ভিড় দেখতে ভিন্ন রকম অনুভূতি পাওয়া যায়।
সদরঘাট থেকে দেশের কোথায় কোথায় লঞ্চ যায়?
সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে পটুয়াখালী, বরিশাল, বরগুনা, ভোলা, ঝালকাঠি, মাদারীপুর, চাঁদপুর, খুলনা, হাতিয়া ও বাগেরহাটসহ প্রায় ৪৫টি রুটে লঞ্চ ও স্টিমার চলাচল করে।
সদরঘাটে নৌকা ভ্রমণের খরচ কত?
সদরঘাটে বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকা ভ্রমণের খরচ সাধারণত ৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত হয়, যা সময় এবং দূরত্বের ওপর নির্ভর করে। তবে নৌকা ভাড়া করার সময় অবশ্যই দামাদামি করে নিবেন।
সদরঘাটের কাছাকাছি দর্শনীয় স্থানগুলো কী কী?
সদরঘাটের কাছাকাছি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান হলো আহসান মঞ্জিল। এটি একটি ঐতিহাসিক প্রাসাদ যা পুরান ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরে। এছাড়া সদরঘাট এর পাশেই বাহাদুর শাহ পার্ক, বড় কাটরা, তারা মসজিদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, আর্মেনিয়ান চার্চ, লালবাগ কেল্লা সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে।
ফেসবুক: কুহুডাক