রাত ২টা ৫২ মিনিট! আমার এক কাঁধে ডিএসএলআর ক্যামেরাটা ঝুলানো, অন্য কাঁধে জামাকাপড় ও অন্যান্য জিনিসপত্র দিয়ে বোঝাই করা ব্যাগ।
আমি সিলেট-ঢাকা মেইন রোডের পাশেই দাঁড়িয়ে আছি। ২ টা ছেলে এতক্ষণ আমাদের দিয়ে আড় চোখে তাকিয়ে থাকলেও এখন ওরা আমার কি এগিয়ে আসছে… আমার সারা শরীরে একটা মৃদু কাঁপুনি বয়ে গেলো। আমি ভয় পেলাম…
আরও: বিমান সুন্দরীগণ সেদিন আমার কথা রাখলেন না
—-
কি অবস্থা সবার? করোনার এই সময়ে যদিও আমাদের সময়টা ভালো যাচ্ছে না তারপরও আশাকরি সবাই ভালো আছেন সুস্থ আছেন।
আজকে আমি ২০২০ সালের শুরুর দিকে আমার সিলেট ভোলাগঞ্জ ভ্রমণ এর একটা রোমাঞ্চকর এবং ভয়ানক কাহিনী আপনার সাথে শেয়ার করব। চলুন শুরু করা যাক…
আমরা বেশ কয়েকজন সিলেট এর সাদা পাথর নামে পরিচিত ভারত বর্ডার এর পাশে ভোলাগঞ্জ ভ্রমণে গিয়েছিলাম। ভ্রমণে বেশ কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল। ২ জন পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার মত অবস্থা হয়েছিল। যেগুলো এই এক ভ্রমণ কাহিনিতে লিখে বলা সম্ভব না। অন্য ভ্রমণ কাহিনীতে বলব।
আজকে শুধু সিলেট ভোলাগঞ্জ থেকে ফিরে আসার রাতের ঘটনা বলার চেষ্টা করব। যেটা আমাদের ভ্রমণের একেবারে শেষের দিকে ঘটেছিল।
আমাদের ফিরে আসার পথে কোন এক কারনে (!) আমার ভ্রমণ সঙ্গী ছোট ভাই আমাদের থেকে আলাদা হয়ে অন্য এক গাড়িতে চলে আসে!
তার কিছুক্ষন পর আমারও নেমে যেতে হয় বা নেমে পরি। তখন রাত প্রায় ৩টার কাছা কাছি হবে। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি রাত ২টা ৫২ মিনিট! শীতের রাত। প্রচণ্ড শীত পরছে। তাছাড়া শীতকালে সিলেটে বেশি শীত হয়।
প্রচণ্ড শীতে আমি রিতিমত কাঁপছি। যদিও আমার গায়ে জ্যাকেট রয়েছে। পরনে ফুল প্যান্ট আর পায়ে কেডস।
এতো রাতে কি করে ঢাকা যাব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। ঢাকা-সিলেট হাইওয়ের পাশে আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমার সাথে একটা ডিএসএলআর ক্যামেরা, কিছু ইলেক্ট্রনিক্স গেজেট আর কাপড়। সাথে অবশ্য তেমন টাকা ছিল না।
আমি ঢাকা যাওয়ার জন্য গাড়ির অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু হাত ইশারা করে অনেকবার গাড়ি থামাবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। এদিকে গভীর রাত। চারদিকে অন্ধকার। কুয়াশার মাঝে কিছুক্ষণ পর পর দূর থেকে এক দুইটা গাড়ির হেড লাইটের আলো জ্বালিয়ে আমার সামনে দিয়ে সা সা করে চলে যাচ্ছে।
আরও: সুন্দরবনে হারিয়ে যাওয়া ৬ কিশোরের শ্বাসরুদ্ধকর ভ্রমণ কাহিনী
এভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলল। হঠাৎ আমার ঠিক কিছুটা দূরেই ২ জন লোক কোথা থেকে যেন এসে উদয় হল! আমি কিছুটা গাভরে গেলাম। পরক্ষনে আমি চারদিকে ভালো করে তাকালাম। দেখলাম, আমার থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটা রেস্টুরেন্ট! রেস্টুরেন্ট এর আলো আমার এখন থেকে ঝাপসা দেখাচ্ছিল। আমি আশার আলো দেখতে পেলাম।
মনে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে রেস্টুরেন্ট এর দিকে এগিয়ে গেলাম।
মাঝারি সাইজের (বড় না আবার ছোটও না টাইপের) একটা রেস্টুরেন্ট খোলা আছে। আমি ভিতরে প্রবেশ করার আগে লক্ষ্য করলাম রেস্টুরেন্ট এর সাথে একবারেই ছোট একটা দোকান খোলা রয়েছে। দোকানের উপরে একটা বিকাশ এর সাইনবর্ডো লাগানো। লিখা আছে এখানে বিকাশ করা হয়।
আমি রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। ভিতরে একজন বসে টিভি দেখছেন। সম্ভবত রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার হবে। কিছুটা দূরে চেয়ারের উপরে ২টা ছেলে বসে আছে। আরেকটা ছেলে একবারে পিছনের দিকে প্লেট পরিষ্কার করছে।
আমি একটা টেবিলে গিয়ে বসলাম। ব্যাগ আর ক্যামেরা রেখে ম্যানেজারকে বললাম ওয়াশরুম কোন দিকে। তিনি আমাকে হাতে ইশারা করে দেখিয়ে দিলেন পিছনের দিকে। আমি বললাম, আমার ব্যাগ আর ক্যামেরাটা একটু দেইখেন। তিকি এবারও হাতে ইশারা করে বললেন ঠিক আছে।
ওয়াশরুম থেকে এসে খাওয়ার জন্য আমি একটা লাচ্চি নিলাম। লাচ্চির টাকা দিতে গিয়ে খেয়াল করলাম আমার কাছে মাত্র ৭৫ টাকা আছে! আমি আমার সেই চলে যাওয়া ছোট ভাই মনিরুজ্জামান কে কল দিলাম। ও অবাক হলো আমি নেমে যাওয়াতে।
আমাকে বলল এখন কোথায় আছেন কিভাবে যাবেন। আমাদের বেশ কিছু কথা হল। টাকার কথা বলাতে ও আমাকে ৫০০টাকা বিকাশ করল।
এদিকে রেস্টুরেন্ট এর ম্যানেজার আমাকে জিজ্ঞেস করল এতো রাতে কোথা থেকে আসলেন? সব কথা শুনার পর ওনি হো হো করে হেসে উঠলেন আর আমাকে বললেন, এরকম অনেক ঘটনা ঘটে ভাই। চিন্তা করবেন না কাছেই একটা বাস স্ট্যান্ড আছে আপনি সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করেন তারপর ঢাকার বাসে করে চলে যেতে পারবেন।
আরও: ভ্রমণ কাহিনী
মোবাইলে চার্জ না থাকায় ওনার কাছে মোবাইল চার্জ দিতে দিলাম। এর মাঝে বন্ধু রনির সাথে আমার ফোনে বেশ কয়েকবার কথা হল। ও আমাকে বেশ কিছু পরামর্শ দিল সাথে এও বলল, তুমি তো একা একা অনেক যায়গায় ভ্রমণ করেছো… আশাকরি তুমি সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাবে।
আমি রেস্টুরেন্ট এর পাশের সেই দোকান থেকে বিকাশ এর টাকা তুললাম। টাকা তুলে মনে হল, আল্লাহ্ সহায় না হলে আমি এতো রাতে জনমানবহীন এইখানে রেস্টুরেন্ট পেতাম কিভাবে আর বিকাশ এর দোকানই বা পেতাম কি করে! আল্লাহ্কে মনে মনে একটা ধন্যবাদ জানালাম।
কিছুক্ষণ বসে থাকার পর রেস্টুরেন্টের সেই ছোট্র ছেলেটা আমার কাছে এসে জজ্ঞেস করলো আপনি কোথায় যাবেন? বললাম: ঢাকা
আমাকে বলল, আপনি একটু এগে আমাকে বললে আমি আপনাকে ওয়ার্ড কাউন্সিলর এর গাড়িতে তুলে দিতে পারতাম। ওয়ার্ড কাউন্সিলর তো তার গাড়ি নিয়ে একটু আগে আমাদের এখান থেকে ঢাকা গেলেন।
আমি ছোট্র এই ছেলের কথা শুনে অবাক হলাম! আমাকে সে চিনে না অথচ সে আমাকে এই কথা বলছে। তারপর আমাকে বলল, চলেন আপানেক গাড়িতে তুলে দেই। আমি ওর দিকে তাকিয়ে মাথা ইশারা করে সায় দিলাম।
আরও: ১ কেজি কলা – শেরপুর, বগুড়া
এবার ২জন মিলে গাড়ি থামাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোন গাড়িই থামে না। আমাদের এই অবস্থা দেখে আরেকটা ছেলে সেন্টু গেঞ্জি গায়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আসল। এসে ছোট ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল ওনি কই যাইব? ছেলেটা বলল ঢাকা যাইব। কিলিগা জানি এখানে এসে গাড়ি থাইকা নাইমা গেছে। এহন কোন গাড়ি পাইতাছে না যাওয়ার লইজ্ঞা।
ছেলেটা আমাকেও কিছু জিজ্ঞেস করল না। সোজা রেস্টুরেন্টে গিয়ে একটা বড় লাঠি নিয়ে আসল! লাঠি নিয়ে সোজা রাস্তার মাঝে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি তো দেখে অবাক! করে কি ছেলেটা!
লাঠি নিয়ে হাত উচু করে দাঁড়িয়ে আছে, আর মুখে বলছে এবার যদি কোন গাড়ি না থামায় এই লাঠি দিয়ে ওগো গাড়ি ভাইজ্ঞা ফালামু।
এই অবস্থা দেখে আমি একটু ইমোশনাল হয়ে গেলাম। আমাকে চিনে না, আমার সম্পর্কে কিছু জানে না, আমার বাড়ি কোথায় তাও জানে না। শুধু জানে আমি ঢাকা যাব। একটা বিপদে আছি, গাড়ি পাচ্ছি না। অপরিচিত একটা মানুষের জন্য আরেকটা ছেলে এরকম করতে পারে আমার আগে জানা ছিল না।
আমার চোখ দিয়ে পানি চলে আসছিল। আমি নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করার চেষ্টা করলাম। ঠাণ্ডায় আমার শরীর বরফ হয়ে যাচ্ছিল। পরিচিত কিছু মানুষ আমাকে এই অন্ধকারে একা রেখে চলে গেলো কিন্তু অপরিচিত ২ টা ছেলে কি আপ্রাণ চেষ্টা করছে আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য।
একটা বাস দূর থেকে লাঠি হাতে একজনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হুইসেল দিচ্ছিল আর হেড লাইট গুলো বার বার জ্বালাচ্ছিল আর নিভাচ্ছিল। লাইট ট্রিমিং করে এটাই বলার চেষ্টা করছিল: সামনে থেকে সরে যাও।
শেষ পর্যন্ত আমরা কোনা গাড়ি থামাতে পারলাম না। গাড়ি থামাবেই বা কেনো! এতো রাতে হাইওয়ে রোডে কে জানে আমরা বিপদে আছি না ডাকাতি করতে চাচ্ছি।
আরও: রাত ২টা ৫২ মিনিট!
শেষমেশ কোন উপায় না দেখে ছেলেটা তার লাঠি ছোট্ট ছেলেটার হাতে দিয়ে বলল, তারাতারি আমার জ্যাকেট্টা লইয়া আয় , আমি ওনাকে বাস স্ট্যান্ড থেকে বাসে তুলে দিয়ে আসি।
ঠিক সেই সময় আম্মা আমাকে কল দিয়েছে! আমি পুরাই অবাক!! এই সময়তো মা আমাকে কখনো কল দেয় না। মা আমাকে বলল, তুই কই আছোস? সব কিছু ঠিক ঠাক আছে তো? সেদিন প্রমান পেলাম ছেলে বিপদে থাকলে মা সত্যি কিভাবে যেন জেনে যায়।
প্রথমে আমি নিষেধ করলাম কিন্তু ছেলেটা আমাকে জোর করেই বলল, চলেন আপনাকে বাসে তুলে দিয়ে আসি।
আমরা ২জন হেটে বাসস্ট্যান্ড এর দিকে যাচ্ছি। প্রচণ্ড ঠান্ডা। প্রায় ১২ মিনিট হাটার পরা আমরা বাসস্ট্যান্ড আসলাম। বাসস্ট্যান্ড এর নাম টা ঠিক মনে নেই। ও আমাকে বলল, আপনি এখানে যে বাস আসবে সেটাতেই উঠতে পারবেন। এখানে বাস থামায়।
১ মিনিটের মাঝেই আমরা বাস পেয়ে গেলাম। আমি বাসে উঠতে উঠতে মানিব্যাগ থেকে ২০০ টাকা বের করে ওকে দিলাম। ছেলেটা নিতে চায় নি, আমি একটু জোর করেই দিলাম। টাকা বেশি থাকলে আমি আরও দিতাম। যদিও আমি জানি এই উপকারের কোন মূল্য হয় না।
ছেলেটা আমাকে শেষে বলল, সাবধানে যাইয়েন। আমি বাসে উঠে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। বাস ঢাকার দিকে এগিয়ে চলল…। আমি ওদের উপকার কখনো ভুলবনা।
আরও: ঈশ্বর রাজ্য কেরল থেকে বাংলার বাড়ি প্রত্যাগমন (ভারত)
ফেসবুক: Kuhudak
অনেক ইন্টারেস্টিং শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ!
ধন্যবাদ 🙂