ভ্রমণ করে আসলাম ৩৫০ বছর পুরনো লুধুয়া জমিদার বাড়ি (Ludhua Jamidar Bari) থেকে! চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর উপজেলার লুধুয়া গ্রামের মিয়াজী বাড়িতে এই জমিদার বাড়িটি অবস্থিত। প্রায় সাড়ে তিনশ বছর পূর্বের ঐতিহ্যবাহী লুধুয়া জমিদার বাড়ি টি এখনো লুধুয়া গ্রামে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে।
লুধুয়া জমিদার বাড়ি – মতলব উত্তর, চাঁদপুর
ভ্রমণ স্থান | লুধুয়া জমিদার বাড়ি |
বিকল্প নাম | মিয়াজি বাড়ি |
অবস্থান | মতলব উত্তর, চাঁদপুর |
নির্মিত | ১৭০০ শতকের মাঝামাঝি |
সমাপ্তি | ১৯৫৭ |
স্বত্বাধিকারী | ছিরাপদি মিয়াজি |
ঢাকা থেকে দূরত্ব | ১৪৭ কিলোমিটার |
এবার চলুন লুধুয়া জমিদার বাড়ি সম্পর্কে কিছু ইতিহাস জেনে নেই।
৪০০ বছরের পুরনো ১ গম্বুজ মসজিদ সম্পর্কে পড়েছেন কি?
ইতিহাস
জমিদার ছিরাপদি মিয়াজির জমিদারিত্ব দিয়ে আজ থেকে প্রায় ৩৫০ বছর পূর্বে লুধুয়া গ্রামে জমিদারি শুরু হয়।
জমিদার ছিরাপদি মিয়াজী ছিলেন অত্যাচারী জিমিদার। লুধুয়া সহ মতলব উত্তর এর বেশিভাগ অংশই তার অধীনে ছিল। প্রজাদের সুখ-দুঃখ দেখায় সময় ছিলনা তার কাছে। জমির খাজনা দিতে কারও দেরি হলে তার অত্যাচার শুরু হতে দেরি হত না।
জিমিদার এর অনেক ঘোড়া ছিল। একেক সময় একেক ঘোড়ায় চড়ে তিনি রাজ্য পরিচালনা করতেন। আজ সেই ঘোড়া নেই তবে ঘোড়ার পানি খাওয়ার সেই ডালা (স্থানীয় ভাষায় নাউন্দা) টি আজো কালের সাক্ষি হিসেবে রয়েছে।
ঘোড়া রাখার সেই ঘরটি নেই। সেখানে এখন হাঁস মুরগীর ফার্ম দেয়া হয়েছে।
ছিরাপদি মিয়াজীরা ছিলেন তিন ভাই। তবে ছিরাপদি মিয়াজীই রাজত্ব পরিচালনা করতেন।
তাদের জমিদারিত্ব এমন পর্যায়ে ছিল যে, লুধুয়া জিমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে ভয়ে কেউ জুতা পরে যেতে পারত না। জমিদার বাড়ির কাছাকাছি আসলেই পায়ের জুতা খুলে হাতে নিয়ে জমিদারবাড়ি পার হবার পর পড়তে হত।
আরও: গজরা জমিদার বাড়ি
জমিদার বাড়ির অত্যাচারের কিছু নমুনা
কথিত আছে, একবার এক গরু ব্যবসায়ী ৮টি গরু নিয়ে ছেঙ্গারচর বাজার থেকে বাড়ি ফিরছিল।
ছেঙ্গারচর থেকে বাড়ি ফিরতে গিয়ে পথিমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে যায়। আর সন্ধ্যা হয় ঠিক রাজবাড়ির কাছে এসেই।
গরু ব্যবসায়ী রাজবাড়ীতে এক রাত থাকার জন্য অনুমতি চাইলে জমিদার অনুমতি দেয়। জমিদার এর পেয়াদা (স্থানীয় ভাষায় মুনি) গরু ব্যবসায়ী কে থাকার রুম দেখিয়ে দেয়। আর তার গরু গুলো কে একটি ঘরে বেধে রাখে।
রাতে গরু ব্যবসায়ীকে খুব খাতির যত্ন করা হয়। তার ডিনার হিসেবে গরু মাংস ভুনা করা হয়। গরু ব্যবসায়ীতো এই আপ্যায়ন দেখে খুব খুশি।
সকালে যখন গরু ব্যবসায়ী চলে যাবে তখন গিয়ে দেখে তার ৮টি গরুর মধ্যে ১টি গরু নেই। গরু ব্যবসায়ী পেয়াদাদের জিগ্যেস করলে তারা বলে, রাতে যে মজা করে গরু ভুনা খেলেন এটা আপনার গরুরই মাংস ছিল! গরু ব্যবসায়ী এই কথা শুনে তো মুর্হা যাওয়ার মত অবস্থা। তিনি কোন রকমে দ্রুত সেখান থেকে চলে আসলেন।
এছাড়াও আরও একটি ঘটনা রয়েছে যা মোটামোটি মতলব এর সবারই জানা। লুধুয়া জমিদার কত ভয়ংকর রকমের অত্যাচারী ছিলেন এই ইতিহাসটি জানলে বুজতে পারবেন।
একদিন জমিদার ও তার আরেক ভাই জমিদার বাড়ির ঠিক সামনে দিয়ে যাওয়া একটি রাস্তার পাশে বসে অরাম করছিলেন। সেই সময়ে একজন সন্তান সম্ভাব্য মহিলা সেই রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছিলেন।
জিমিদার ছিরাপদি মিয়াজী তার ভাই কে বললেন, এই মহিলার যে বাচ্চা হবে সেটা হবে ছেলে। তুই কি বলিস?
জিমিদার এর ভাই এই কথা শুনে বললেন, না না… মহিলার পেটে যে বাচ্চা আছে এটি মেয়ে! এই নিয়ে দুই ভাই এর মধ্যে তর্ক বেধে গেলো। এরপর তারা তর্ক বন্ধ করে একটা সিদ্ধান্তে আসল।
তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, তারা মহিলার পেট কেটে বাচ্চা বের করে দেখবে ছেলে নাকি মেয়ে। ভাবা যায়? অত্যাচারী দুই ভাই তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী মহিলাটিকে পেয়াদা দিয়ে ধরে নিয়ে তার পেট কেটে পরীক্ষা করে দেখেছিল! সন্তানটি ছেলে নাকি মেয়ে!!
এরকম বেশকিছু ঘটনা রয়েছে এই লুধুয়া জমিদার বাড়ি নিয়ে।
আরও পড়ুন: নাউরী মন্দির ও রথ
অন্ধর মহল
লুধুয়া জমিদার বাড়িতে একটি অন্ধর মহল রয়েছে। যেটা এখনো রয়েছে।
এই অন্ধর মহলে জমিদাররা তাদের যত অপকর্ম রয়েছে সব করত এখানে। অন্ধরমহল এর একপাশে বেশ বড় একটি কুপ রয়েছে। যা বর্তমানে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। কাউকে ভিতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না।
কথিত রয়েছে, যাদের সাথে এই জমিদার এর কোন জামেলা বা যারা জমিদার এর কথা ঠিক মত পালন করত না, তাদের কে পেয়াদা দিয়ে ধরে এনে এখানে মেরে ফেলে দিত।
অবস্থান ও স্থাপনাসমূহ
চাঁদপুর থেকে লুধুয়া জমিদার বাড়ির দূরত্ব প্রায় ২৪ কিলোমিটার। চাঁদপুর থেকে লুধুয়া জমিদার বাড়ির অবস্থান উত্তরে। এটি মতলব উত্তর উপজেলার লুধুয়া গ্রামের মিয়াজী বাড়িতে অবস্থিত।
পূর্বে এই জমিদার বাড়িতে অনেক স্থাপনা থাকলেও বর্তমানে ৩টি স্থাপনা অবশিষ্ট রয়েছে। এই তিনটি স্থাপনার ভিতরে জমিদার এর একটি খাসকামরাও রয়েছে। এর ভিতরে নিরাপত্তা পহরি থাকার ঘরের নিদর্শন পাওয়া যায়।
৩টি স্থাপনার সবগুলোই বর্তমানে জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তবে খুব একটা সংস্কার কাজ করা হয়নি। প্রত্যেকটি বিল্ডিংই দুই তলা বিশিষ্ট। নিরাপর্তার জন্য দুই তলা কে ভেঙ্গে এক তলা করা হয়েছে।
এছাড়া জমিদারের ঘোড়ার পানি খাওয়ার জন্য ডালা এবং কয়েকটি বড় দিঘি রয়েছে।
জমিদার প্রথার বিলুপ্তি
আইয়ুব খানের আমলে এই জমিদার প্রথা বিলুপ্ত হয়ে যায়। তখন থেকেই এই লুধুয়া জমিদার বাড়ির জমিদারিত্ব বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর অবশ্য এটা নিয়ে কেউ তেমন মাথা ঘমায় নি।
আরও পড়ুন: জজ নগর (Judge Nagar) ভ্রমণ
লুধুয়া জমিদার বাড়ি ভ্রমণ
আমি ( আরিফ হোসেন ) এবং মোফাজ্জেল অনেকদিন ধরেই জমিদার বাড়ি যাওয়ার প্লান করছিলাম। তবে সময়ের অভাবে যাওয়া হয়ে উঠছিল না। ১৩ই ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখে আমরা যাওয়ার প্লান করলাম এবং মোটরসাইকেল করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
আমরা প্রায় দুপুর এর দিকে লুধুয়া জমিদার বাড়ি গিয়ে পৌছালাম। যদিও বাড়ি চিনতে একটু সমস্যা হয়েছে। মোফাজ্জেল এর সাথে আবুল হোসেন মিয়াজির পরিচয় ছিল আগে থেকেই। আবুল হোসেন মিয়ায়জীর বয়স ৭০ এর উপরে।
আবুল হোসেন মিয়াজীর বাবার নাম এলাহি বক্স মিয়াজী। তার বাবার নামঃ হাজী মোজাফফর মিয়াজী। তার বাবারা ছিলেন ৩ ভাই। কেয়া মদ্দিন মিয়াজী, এয়া মদ্দিন মিয়াজী এবং নিজাম উদ্দিন মিয়াজী! এভাবে করেই ছিরাপদি মিয়াজী পর্যন্ত চলে গিয়েছে।
আবুল হোসেন মিয়াজী আমাদেরকে পুরো জমিদার বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখালেন।
লুধুয়া জমিদার বাড়ির বর্তমান অবস্থা
বর্তমানে লুধুয়া জমিদার বাড়িতে যারা আছেন তারা ৩টি পরিবারে বিভক্ত। জমিদার বাড়ির ৩টি স্থাপনা এবং পুকুর তারা তিন পরিবার ভাগ করে নিয়েছে। তিন পরিবারই তাদের ভাগের স্থাপনা গুলো পরিচর্যা এবং সংরক্ষন করেন।
তবে, আমরা সরেজমিনে গিয়ে যা দেখতে পাই তা হলঃ প্রত্যেকটি স্থাপনাই ভাঙ্গাচুরা। স্থাপনার দেয়ালে শৈইবাল জন্মেছে। এছাড়া নানা উদ্ভিত জন্মে আছে দেয়ালে। জানালা গুলো কাঠ দিয়ে আটকানো।
বাড়িতে নানা জাতের মুরগীর খামার দেয়া আছে। পুকুর গুলোতে মাছ চাষ করা হয়। এছাড়া নতুন মসজিদ তৈরি করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: খোদাই পুকুর রহস্য
কিভাবে যাবেন
চাঁদপুর থেকে লুধুয়া জমিদার বাড়ির দূরত্ব প্রায় ২৪ কিলোমিটার। আপনি চাঁদপুর থেকে CNG করে মতলব বাজারে চলে আসতে পারবেন। ভাড়া নিবে ৪০টাকা। মতলব বাজারে নেমে কিছু নাস্তা করে নিতে পারেন। এরপর নৌক দিয়ে নদী পার হতে হবে আপনাকে। অথবা আপনি যদি গাড়ি নিয়ে আসেন তাহলে, চাঁদপুর থেকে নতুন ব্রিজে করে সিপাইকান্দি চলে আসতে পারবেন। ব্রিজটি কিছুদিন আগেই উদ্বোধন করা হয়েছে। এছাড়া নদী পারাপারের জন্য ফেরি রয়েছে।
নৌক দিয়ে নদী পার হয়ে যান। নৌক দিয়ে নদী পার হতে ৫টাকা নিবে। আবার ঘাটেও ৫ টাকা নিবে। আর ব্রিজ দিয়ে আসলে এই টাকা দিতে হবে না।
নদী পার হয়ে আপনি গজরা বাজার যাওয়ার জন্য CNG বা মোটরসাইকেল পাবেন। CNG বা মোটরসাইকেলে উঠার আগে বলে দিবেন আপনি লুধুয়া কলেজ এর সামনে নেমে যাবেন।
লুধুয়া কলেজের সামনে নামার পর যে কাউকে জিগ্যেস করলেই আপনাকে লুধুয়া জমিদার বাড়ি দেখিয়ে দিবে।
ফেসবুক: Kuhudak
খুব ভালো লাগলো চাঁনপুর, মতলবপুর এর লুধুয়া র মিরাশদার মিঞাজী বাড়ির মিয়াদের মিয়াগিরির শুনে।
আচ্ছা মিঞাজী পদবির অর্থ কি মিঞাজী বাড়ির মিঞাদের কাছে থেকে জেনে নিয়েছিলেন তো, না জানলে জেনে নিন।
মিঞাজী/ মিয়াজী পদবীর অর্থ?
মিঞাজী/মিয়াজীঃ-
(মিঞা + জী ) = মিঞাজী
মিঞা/মিয়াঃ- মিঞা মুসলিম উচ্চ পদস্ত সামাজিক ব্যক্তিকে সম্বোধন করার জন্য ব্যবহৃত সম্ভ্রম সূচক শব্দ।
মিঞা ফার্সী শব্দ এর অর্থ হলো প্রভু,সর্দার,প্রধান ইত্যাদি।
জীঃ জী সম্মান সূচক শব্দ, এর অর্থ জনাব,সাহেব,
মহাশয় ইত্যাদি।
মিঞাজীঃ-
মিঞাজী পদবী মুসলীম সমাজে উচ্চ পদস্ত সর্বেসবা মর্যাদাশীল সামাজিক ব্যক্তিকে সম্বোধন করার জন্য ব্যবহৃত সম্ভ্রম সূচক শব্দ।
মিঞাজী অর্থ হলোঃ- মহাপ্রভু, সর্বোপ্রধান বা প্রধানজী,সর্দারে আলা ইত্যাদি।
আপনাকে ধন্যবাদ।
লুধুয়া জমিদার বাড়িটি মতলব এর গর্ব। আপনি লুধুয়া মিয়াজী বাড়ির দেখে আরও ভালো লাগল। আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ Hridoy ভাই 🙂