সিলেটিরা কি বাঙালি নয়? গত কিছুদিন ধরে সিলেটের জাফলং নিয়ে কুহুডাকের ফেসবুক পেইজে কিছু পোস্টে এমন কিছু মন্তব্য দেখেছি যা প্রমাণ করে, সিলেটের অধিবাসীদের জাতিগত পরিচয় নিয়ে বেশ কিছু মিশ্র অনুভূতি ও ভুল ধারণা রয়েছে।
কুহুডাক ফেসবুকের একটি পোস্টে লিখেছে, “এখানে উপজাতিদের পাশাপাশি সাধারণ বাঙালিরা বসবাস করে থাকেন।” (মূল পোস্ট) এই বাক্যাংশটিকে ঘিরে কিছু পাঠক নিজেদের পরিচয় ও ঐতিহ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এই বিষয় নিয়ে মতামত প্রকাশ করার প্রয়োজন অনুভব করছি, কারণ বিষয়টি শুধু ভাষা বা জাতিগত পরিচয়ের সীমাবদ্ধ নয় বরং বাংলাদেশের বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে বোঝার সাথে সম্পর্কিত।
আরও: কেমন বাংলাদেশ চাই?
সিলেটের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক পরিচয়
সিলেটের ইতিহাস দীর্ঘ ও সমৃদ্ধশালী। এটি একটি বৈচিত্র্যময় অঞ্চল, যেখানে মিশে আছে আদিবাসী খাসিয়া এবং মণিপুরী জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি, শতাব্দী ধরে বসবাসরত সিলেটি মুসলমান, হিন্দু এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষেরাও। সিলেটি সংস্কৃতি, ভাষা, এবং জীবনধারা বাংলাদেশের মূলধারার বাঙালি সংস্কৃতি থেকে কিছুটা আলাদা হলেও, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন সংস্কৃতি নয় বরং বাঙালি সংস্কৃতির একটি বহুবৈচিত্র্যপূর্ণ শাখা। সিলেটিরা নিজেদের সিলেটি বাঙালি হিসেবে পরিচয় দেয় এবং বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐক্যে অবদান রাখে।
ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের পার্থক্য
অনেকেই মন্তব্য করেছেন, সিলেটিদের ‘বাঙালি’ পরিচয় নিয়ে। এতে বোঝা যায় যে, সিলেটি এবং বাঙালি পরিচয়ের মাঝে কিছুটা বিভ্রান্তি রয়েছে। সিলেটিরা বাঙালি জাতির অন্তর্ভুক্ত হলেও তাদের নিজস্ব একটি ভাষা রয়েছে যা বাংলা ভাষার থেকে কিছুটা আলাদা। এটি মূলত পূর্ব মধ্য বঙ্গীয় ভাষার একটি প্রাচীন রূপ, যা সিলেটি নাগরি লিপিতেও লেখা হতো। এই সিলেটি ভাষা এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত সংস্কৃতির আলাদা অবস্থান থাকার কারণে কিছু মানুষ মনে করেন, সিলেটিরা যেন ‘আলাদা’ কিছু।
আদিবাসী ও বহিরাগত বাসিন্দাদের ভূমিকা
সিলেট অঞ্চলে খাসিয়া, মণিপুরী এবং অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বাস রয়েছে, যা সিলেটের বৈচিত্র্যকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। জাফলং ও আশেপাশের এলাকার খাসিয়া জনগোষ্ঠী একটি বিশেষ ঐতিহ্যবাহী জনগোষ্ঠী, যারা তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা করে চলেছে। অন্যদিকে, সিলেটে সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এসে বসতি গড়ে তুলেছে, যা সিলেটের সংস্কৃতির সাথে মিশে গিয়ে এক নতুন বাঙালি ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছে। আদিবাসী এবং সিলেটি বাঙালি উভয়েই এই অঞ্চলের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবয়বকে রূপ দিয়েছে।
আরও: বাংলাদেশের গ্রামীণ মেলা কি হারিয়ে যেতে বসেছে?
“বাঙালি” পরিচয়ের প্রসঙ্গ
বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘বাঙালি’ পরিচয়টি জাতিগত সীমানার বাইরে একটি সর্বজনীন সাংস্কৃতিক ও জাতীয় পরিচয়। জাতি হিসেবে আমরা যেমন বাংলাভাষী, তেমনই আমাদের সংস্কৃতির মূল ভিত্তিও বাংলা ভাষার সঙ্গে সম্পর্কিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে জাতির বিভিন্ন আন্দোলনে বাঙালি পরিচয়ের একাত্মতা প্রকাশ পেয়েছে, এবং এই পরিচয়টি আমাদের জাতীয় ঐক্যের অন্যতম প্রধান প্রতীক। তবে এটি মনে রাখা উচিত যে, ‘বাঙালি’ পরিচয় কোনো একক সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে নয়, বরং বিভিন্ন ভাষা ও জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত।
সিলেটিদের আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে কী বলা যেতে পারে?
যদিও সিলেটিরা একটি আলাদা ভাষার ব্যবহার করে, তবুও তারা বাংলাদেশের তথা বৃহত্তর বাঙালি জাতির অংশ। ইতিহাস ও ঐতিহ্যগতভাবে সিলেটিরা এই দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং বাংলাদেশের সুনীল-সবুজ পতাকা শুধু ঢাকায় নয়, সিলেটেও সমান মর্যাদার সঙ্গে স্থান পেয়েছে। তাই সিলেটি পরিচয় বাঙালি পরিচয়কে কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত করে না, বরং এটি বাঙালির বহুমুখী সাংস্কৃতিক চর্চাকে আরও সমৃদ্ধ করে। সিলেটিদের বাঙালি হিসেবে না গণ্য করা এই ঐক্যের ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
সবশেষে বলতে চাই যে, বাঙালি পরিচয় মানে একটাই রং বা সংস্কৃতি নয়, বরং এটি বৈচিত্র্যময় এবং এর মধ্যে সিলেটিরাও রয়েছেন।
ফেসবুক: কুহুডাক