ঈশ্বর রাজ্য কেরল থেকে বাংলার বাড়ি প্রত্যাগমন (ভারত)। প্রায় কুড়ি দিন আগে টিকিট করেছি। এক টানা ট্রেন না পাওয়ায়, কেটে কেটে বাড়ির স্টেশন মুরারই পর্যন্ত টিকিট। কন্সেশনের অপেক্ষায় টিকিট কাটতে দেরি হয়, নয়লে আরও আগে হয়ে যেত।
আসা যাওয়া মিলে মোটামুটি হাজার টাকা লেগেছে। অনিকুল আর আলী আহমেদ কাউন্টারে টিকিট রিজার্ভেশনের জন্য গিয়েছিল। প্রত্যেক ট্রেন টিকিটের আলাদা আলাদা পিএনআর নম্বর স্পাইরাল নোটবুকে লিখে নিয়েছে। সময় সুযোগ পেলে ডিজিটাল লাইব্রেরীতে গিয়ে কমবেশি প্রত্যেকদিনই টিকিট কনফার্মেশনের স্ট্যাটাস চেক করি।
আরও: ভ্রমণ কাহিনী
টিকিট এখনও কনফার্ম হয়নি। ৫ তারিখ আসর নামাজের আগেই বেরিয়ে গেলাম। আলী আহমেদের জেদ কাছের স্টেশন পারপাঙ্গাডি নয়; কৈকোড স্টেশন থেকেই ট্রেন ধরবো। ৬ তারিখ ভোর তিনটেয় ট্রেন। তার আগে সেখানকার মার্কেট পরিদর্শন, সমদ্র সৈকত সব উপভোগ করবো। আসিফকে ফোন করে বলে দিয়েছিলাম যে আজ আমরা তাদের কাছের স্টেশন দিয়ে যাচ্ছি।
মাম্বুরাম শরীফ
আশরাফ উস্তাদের কথানুসারে আমরা সর্ব প্রথম মাম্বুরাম শরীফ গেলাম। মাম্বুরাম শরীফ কেরালার সর্বাধিক পরিদর্শিত আধ্যাতিক কেন্দ্র। এখানে যিয়ারাহ, কেনাকাটা, উস্তাদের সঙ্গে একটি সেলফি ফটো তুলে আমরা যথা আমি, আনিকুল, সামিউল আর কৈকোডের ভুত আলী আহমেদ পারপাঙ্গাডি রেল স্টেশনের উদ্দেশ্য কেরালার সর্বক্ষণ ঝনাঝন বৃষ্ট্রি উপেক্ষা করে এগিয়ে পড়লাম। আসমাউল ও খাদিমুদ্দিন আমাদের সঙ্গে আসলনা। কৈকোড পার করে ট্রেন যখন পারপাঙ্গাডি আসবেই তখন তারা চাপবে।
কৈকোড স্টেশন
কাকা আসিফ, বন্ধু রাহুল এবং লিটন এক ঘন্টা ধরে কৈকোডে আমাদের অপেক্ষা করছে। আমি ফোন করায় ১০ কিলোমিটার দূর কর্মস্থান থেকে তারা শুধুমাত্র আমাদের দেখা করতে এসেছে। আমাদের আসতে দেরি হচ্ছে বলে তারা কৈকোড সমুদ্র সৈকতের আনন্দ উপভোগ করতে গিয়েছিল। স্টেশনে নেমে ফোন করে ওদের ডাকলাম। অগাধ স্নেহের সঙ্গে আসিফ-দল আমাদের চা পান করার নামে এক বড় হোটেলে বিরয়ানি খাওয়ালো। তারপর গল্প করতে করতে পার্শে প্রশস্ত এক বড় শপিং মার্কেট ঘুরালো। আমাদের ওই মার্কেটে রেখে তারা নিজ বাসস্থানে ফিরে যায়। কেরালা সামগ্রী বাড়ি নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে আমরা যা নেওয়ার কিনে আলী আহমদের নেতৃত্বে গুগল ম্যাপ দেখতে দেখতে কৈকোড বীচের দিকে হাঁটতে আরম্ভ করলাম।
কেরালা পর্যটন দ্বারা সমুদ্রধার ধরে নির্মিত বিভিন্ন আকর্ষণীয় সরঞ্জাম দিয়ে সুসজ্জিত লম্বা ঘাটে ছিটছাট মানুষের দল ঘোরাফেরা করছে, কেউ আবার উলোম্ব স্তম্ভের সামনে পিছনে দাঁড়িয়ে ফটো তুলছে কেউ কেউ ঢালাই তৈরি আসনে বসে কোনো বিষয়ের উপর মৃদু হাসির সঙ্গে কথা বলছে। আমরাও সবটাই করলাম। তারপর স্টেশনে গিয়ে ওয়েটিং রুমে গিয়ে নিন্দ্রা বিশ্রামের ব্যাবস্থা করি। রাত পেরিয়ে ভোর তিনটেয় ওয়েস্ট কোস্ট এক্সপ্রেস ট্রেন।
মোবাইলের স্ক্রিনে জেগে, কখনও ঘুমিয়ে আমাদের রাত অতিবাহিত হয়। আমার মোবাইলটা প্রায়ই অনিকুলই ব্যাবহার করছে। আমি ঘুমাবার অবিরাম চেষ্টা করছি, কিন্তু বিফল। টিকিট আমাদের কনফার্ম ছিল। কৈকোড থেকে এমজিআর চেন্নাই সেন্ট্রাল পর্যন্ত বাড়ি প্রত্যাগমনের উদ্দেশ্যে আমাদের ট্রেন যাত্রা ছিল খুব আরামের।
আরও: লেঙ্গুরা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি
মার্কেট মসজিদ
দুপুর তিনটার পর চেন্নাইয়ে পৌঁছায়। রাত সাতটায় হাওড়া মেল। তার আগে স্টেশন থেকে বের হয়ে মার্কেট মসজিদে ধোয়াধয়ী করে পরিষ্কার হলাম। আসর নামাজ আদায় করে এক বাঙালি হোটেলে মাছ ভাত খেলাম। অনেক দিন পর এই বাংলার স্বাদ! বাড়ি গিয়ে মুড়ি, খিচুরী আর পান্তা ভাত খাবার প্রবল আকাঙ্খা। তারপর আবার রেল স্টেশনে ফিরে ঠেসাঠেসি ভিড়ের মধ্যে ব্যাগ টেনে টেনে ট্রেনের স্লিপার কোচের এক সিট ধরে বসলাম। টিকেট কনফার্ম হয়নি, ওয়েটিং লিস্ট।
ট্রেন ছাড়বার এক মিনিট আগে হুড়মুড় করে এক মধ্যবর্ষ সহ চার পাঁচজন সমবয়সী মানুষ ঢুকে পড়ল আদের বার্থে। প্রথমে কার… কার… বলে চিৎকার করে ব্যাগ সমগ্র হটিয়ে ফেলল। তার পর আমাদের উঠিয়ে ওদের প্রত্যেক সদস্যদের বসালো। বসবার মত জায়গা খালি থেকে গেলে পা লম্বা করে তাও পূরণ করে দিল। আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম। ট্রেন চলতে আরম্ভ করে। বসতে গেলেই বুড়ো ধমক দেয়। ব্যাগটা রাখার জায়গা দিতে সে মেতে উঠছে পাগলের মত। আলী আহমেদের অভিমান: আমাদের প্রত্যেক বারই টিকেট কনফার্ম থাকে। আমরা কত অ্যাডজাস্ট করি। ওকে একদিন দেখাবো।
ট্রেন ভ্রমণ
আমাদের ট্রেন মনে হচ্ছে চলছেনা। বাড়ি আসা যাওয়াতে আগে দিন গুনতাম, এখুন ঘণ্টার ঘন্টা মনে হচ্ছে এক একটা দিন। পায়ের নিচে ব্যাগটি রাখতে পেরেছি। রাত হয়েছে। ভেবেছিলাম সিট না পেলে নিচেই চাদর বিছিয়ে ঘুমিয়ে পরবো। কিন্তু দেখি তারও কোনো অবকাশ নেই। ব্যাগের ওপর ভর দিয়ে আসতে আসতে বসে পরলাম। ওইভাবে বসে বসে জেগে ঘুমিয়ে প্রথম রাত অতিক্রম হয়।
সকাল দিকে মনে হয় একটু ঘুম হয়েছিল। উঠে দেখি সবাই জেগে আছে – কেউ রাত্রে পাওয়া জায়গায় বসে আবার কেউ দাঁড়িয়ে। আমার খুব জোর পেশাব লেগেছে, তাই বার্থ বাঁক নিয়ে টয়লেটের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করি। এক পা ফেলার কোনো জায়গা নেয়। আপার সিটে চাপবার জন্য সিড়ির লোহা ধরে ধরে ওপর ওপর গেটের বন্দরের পিছনে পৌছায়। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। কষ্ট করে ওপরেই লোহার উপর বাথরুমের অপেক্ষায় বসে থাকলাম।
আধ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে এখনও শোচালয়ে যেতে পারিনি। এবার ওপর থেকে নেমে দাঁড়ালাম। একটু একটু করে আগাচ্ছি। একটি টয়লেট গেটের আগে-পরে যাওয়া নিয়ে প্রতিযোগিতা চলছে। অন্য টয়লেট গেট বন্ধ। কেউ কেউ গালি দিয়ে থাবরাচ্ছে, কিন্তু গেটটি খুলছে না। যেমনকি আমি বাথরুমে ঢুকেছে তখনই একজন অশ্লীল গালাগালি করে, মারবো ধরবো চিৎকার করে দ্বিতীয় বাথরুমের কপাট ঢেঁকলাতে আরম্ভ করেছে। বন্ধ দরজার পিছন থেকে চার জন শ্রমিক যুবক বের হয়। আমি পরিস্থিতি দেখে সন্ত্রাস্ত হয়ে পড়ি। তাড়াতাড়ি বাথরুম থেকে বের হয়ে নিজের দাঁড়িয়ে থাকার সিটের দিকে চলে আসার চেষ্টা করি। তাদের নিয়ে বাকি শ্রমিক যাত্রীদের খুব হৈহাল্লা চলতে থাকে। এই রকম দশায় আমরা হাওড়া পৌঁছায় রাত এগারোটায়। পরের ট্রেন শিয়ালদহ থেকে মুরারই জন্য কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস ভর সাড়ে ছ’টায়।
আলী আহমেদ বাকি কিছু ছেলেদের সঙ্গে হাওড়া থেকেই রাত দুটায় এক ট্রেনে বর্ধমান পর্যন্ত চলে যায়। তারা এক ঘন্টা আগে পৌছাবে। আমরা তিনজন যথা আমি, অনিকুল ও সামিউল এক টেক্সী ধরে শিয়ালদহ যায়। টুকটাক খাওয়া দাওয়া করলাম। পে অ্যান্ড ইউজ বাথরুমে গোসল করে কাপড়ও পরিবর্তন করলাম।
পুরো শরীর ভেঙে পরেছিল। কৈকোডের মত স্লিপার টিকেটবালাদের জন্য ওয়েটিং রুম খুঁজে না পাওয়ায় উন্মোক্ত স্টেশনের উপর চাদর বিছিয়ে ঘুমিয়ে যায়। অনিকুল ঘুমায়নি; মোবাইল নিয়ে সে আমাদের পাহারা দিচ্ছিল। তবুও ভোর পাঁচটায় উঠে দেখি আমার জুতো জোড়া নেয়। অনিকুলের সাফাই: এক বৃদ্ধ পাশে বসে ছিল, সম্ভবত সেই নিয়ে পালিয়েছে।
আরও: সুন্দরবনে হারিয়ে যাওয়া ৬ কিশোরের শ্বাসরুদ্ধকর ভ্রমণ কাহিনী
কাঞ্চনজঙ্ঘা
এবার কাঞ্চনজঙ্ঘা ধরি। এতেও ভিড় অসাধারণ। প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা। উঠে বসে, ব্যাগ ধরে রেখে খুব কষ্টের সঙ্গে মুরারই আসি। আনিকুলের হাওয়াই চপ্পল পরে ছিলাম। ট্রেন থেকে নেমে জানালা দিয়ে তার চপ্পল জোড়া দিয়ে দিলাম। স্টেশন থেকে বের হয়ে দুশো টাকার একটা জুতো কিনলাম। একটু খাওয়া দাওয়া করে আসল গন্তব্যস্থল রদিপুরের টোটো ধরি। টোটোবালা পাশের গ্রাম বরহা যাবে বলে পলশা মরে আবার কুড়ি মিনিটের মত অপেক্ষা করতে হয়। জুম্মার দিন আবার নামাজের সময় এখন টোটো পাওয়া মুশকিল। সে ফিরে আসলে তাকে নিয়ে বাড়ি চলি। ঘর ঢুকতেই দরজায় মায়ের সঙ্গে দেখা। মাতৃ মমতার মাত্রা অতিক্রম হয়ে তাঁর চোখে অশ্রুজল ঝরতে আরম্ভ করে।
ভ্রমণ কাহিনী লিখেছেন: মহ: সোহেল মন্ডল (ভারত)
ফেসবুক: Kuhudak