একদিনে ইলিশ খেতে মাওয়া ফেরি ঘাট (Mawa Feri Ghat), মুন্সিগঞ্জ ভ্রমণ করে আসলাম। আসসালামু আলাইকুম। আসাকরি আল্লাহ্ অশেষ রহমতে সবাই ভালো আছেন। বেশ অনেক দিন পর লিখতে বসলাম। আজকে আপনাদের ইলিশ খাওয়ার জন্য বিখ্যাত স্থান মাওয়া ঘাটের তাজা ইলিশ ভাজা কিভাবে খাবেন এবং মাওয়া ফেরি ঘাট ভ্রমণ সম্পর্কে বলব।
তো চলুন শুরু করা যাক…
আমরা জানি ইলিশ এর জন্য ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর বিখ্যাত। কিন্তু ঢাকার অদূরে মুন্সিগঞ্জ জেলার মাওয়া ফেরি ঘাট বেশ অনেদিন ধরে ভোজন প্রেমিদের কাছে বিখ্যাত হয়ে আছে। তবে, এটি ঢাকার কাছে এবং সড়ক ব্যবস্থা চমৎকার হওয়ায় এখানে পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে।
মাওয়া ফেরি ঘাট, মুন্সিগঞ্জ
মাওয়া ফেরি ঘাট, মুন্সিগঞ্জ -এ বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভ্রমণ প্রেমী এবং ভোজন রসিকরা ছুটে আসেন ইলিশ খেতে। তবে, এখানে শুধু ইলিশ মাছ’ই পাওয়া যায় তা নয়! সামুদ্রিক অন্যান্য বাহারি প্রজাতির মাছ রয়েছে এখানে। নদী থেকে ধরে আনা টাটকা ইলিশ মাছ ভেজে খেতে কি যে দারুণ লাগে, আহা… সাথে ইলিশ এর ঘ্রাণ! ভাবা যায়।
ভ্রমণ স্থান | মাওয়া ফেরি ঘাট |
ধরন | দর্শনীয় স্থান, ইলিশ মাছ খাওয়া |
অবস্থান | মুন্সিগঞ্জ (বিক্রমপুর), ঢাকা, বাংলাদেশ |
ঢাকা থেকে দূরত্ব | ৫৭ কিলোমিটার প্রায় (সড়কপথ) |
ড্রোন উড়ানো যাবে | হ্যাঁ |
বিখ্যাত | ইলিশ মাছ |
একদিনে মাওয়া ফেরি ঘাট ভ্রমণ
একদিনের জন্য মাওয়া ফেরি ঘাট সব চেয়ে বিখ্যাত। মাওয়া ফেরি ঘাট পদ্মা সেতুর শুরু বা পদ্মা পাড়ে অবস্থিত। ঢাকা থেকে প্রাইভেট কারে মাওয়া যেতে ৩০ মিনিট এর মত সময় লাগে। তাই সময় পেলেই খাওয়া এবং ঘুরার জন্য এই স্থানটি কে সবাই সহজে বেছে নেয়।
এদিকে সড়ক পথ এর অবস্থা খুবই ভালো। একটানে আপনি চলে যেতে পারবেন মাওয়া। এখানে অনেকেই আসেন মোটরসাইকেল করে, আবার অনেকে নিজস্ব বা গাড়ি ভারা করে আসেন। এছাড়া ঢাকা থেকে আসার জন্য নির্দিষ্ট কিছু বাস রয়েছে। কিভাবে যাবেন (ভ্রমণ গাইড), সে বিষয়ে একটু পরে বলছি।
যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো, অল্প সময়ে যাওয়া যায়, ঘুরার পাশাপাশি নদীতে স্পিড বোড নিয়ে ভ্রমণ সাথে আবার নদি থেকে ধরে আনা টাটকা ইলিশ মাছ খাওয়া এই সব কিছু এক সাথে পাওয়া সপ্নের ব্যাপার। আর সেটা যদি পাওয়া যায় তা হচ্ছে একমাত্র মাওয়া ফেরি ঘাট।
ভ্রমণের দিন
এবারের মাওয়া ভ্রমণ হুট করে হয়েছে বলা যায় আবার বলা যায় না! আগেই বলে নেই এবারের ভ্রমণে আমরা ৬ বন্ধু (স্কুল ফ্রেন্ড) ছিলাম সাথে ছিল আমার ভ্রমণের সাথি দাদু (নাদিম)। ব্যাপারটা হচ্ছে, নাদিহ প্রায়ই আমাদের বন্ধুদের মাঝে গেট-টুগেদার এর আয়োজন করে থাকে।
১৭ জুন নাহিদ আমাকে ফোন করে জানালো যে, সবাই মিলে মাওয়া যেতে চায়। আমি যদিও এর আগে মাওয়া গিয়েছি। পরদিন অফিস আসলাম। ইতিমধ্যে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি ভেবে নিয়েছিলাম যে, হয়তো আজকে মাওয়া যাওয়া হবে না।
দুপুরের দিকে আব্দুল ফোন করে জানালো যে, মাওয়া যাওয়ার জন্য সবাই নাহিদ এর অফিসে (মতিঝিল) একত্রিত হচ্ছে। আমিও যাতে দ্রুত চলে আসি।
দুপুর ২টা। ইতিমধ্যে সাগর ছাড়া সবাই চলে আসছে। সাগর আসবে গাজীপুর থেকে তাই আসতে একটু দেরি হচ্ছে। আমি লাঞ্চ করে অফিস থেকে বের হলাম। বাসায় গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে নাহিদ এর অফিস এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। নাদি এর অফিস আমার অফিস এর কাছেই। রিক্সা দিয়ে যেতে ৫ মিনিট এর মত সময় লাগে।
নাদিহ এর অফিসের লিফট এ গিয়ে সাগর এর সাথে দেখা হল। আমরা নাদিহ এর অফিসে গেলাম। ইতিমধ্যে সবাই চলে আসছে। আমরা কিছুক্ষণ গল্প করে মাওয়া ফেরি ঘাট এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। বাহিরে বৃষ্টি নেই।
মাওয়া ফেরি ঘাট এর উদ্দেশ্যে যাত্রা
নাদিহ একটা হাইস (HiAce) গাড়ি ভাড়া করেছে। মতিঝিল থেকে আমরা গাড়িতে উঠলাম। আমাদের এক বন্ধু সামনে থেকে উঠবে। আমরা মাওয়া ফেরি ঘাট এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম।
গাড়ি কিছুদূর যেতেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শুরু হলো। আমরা গল্প করতে করতে যেতে লাগলাম। বন্ধুরা একসাথে হলে যা হয়, পুরনো সব স্মৃতি জেগে উঠে। আমাদের স্কুল জিবনে ঘটে যাওয়া নানা মজার মজার গল্প করছিল সবাই। নাদিম মোবাইল দিয়ে ভিডিও করছিল।
কি চমৎকার রাস্তা! দেখতেই অসাধারণ লাগে। দুই পাশে ফুলের গাছ প্রথম ব্রিজ… দুই পাশে সবুজ ঘাস যুক্ত জমি ২য় ব্রিজ… এভাবে করে একটু পর পর ব্রিজ! দূর থেকে দেখলে আপনার মনে হবে নদীর ঢেউ এর মত। উচু ব্রিজ আবার নিচু আবার উচু ব্রিজ।
আমি মোবাইল দিয়ে ভিডিও করার চেষ্টা করছিলাম। গাড়ির মাঝামাঝি বসাতে জুম করে ভিডিও করতে হচ্ছিল। বাহিরে যেহেতু গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল তাই গাড়ির সামনের কাচে বৃষ্টির ফোঁটা দিয়ে ভরে যাচ্ছিল। ড্রাইভার একটু পর পর সেটা পরিষ্কার করে দিচ্ছিলেন। আমরা এগিয়ে যেতে থাকলাম।
আরও: তারুয়া সমুদ্র সৈকত
পদ্মা সেতু
আমরা মাওয়া ফেরি ঘাট এর কাছেই চলে এসেছি। সামনে চোখে পড়ল পদ্মা সেতু (Padma Bridge)! এখনও পদ্মা সেতু উদ্বোধন করা হয় নি। সামনে উদ্বোধন হবে তাই পুরো দমে কাজ চলছে। কিছুটা এগোতেই চোখে পড়ল উদ্বোধন এর জন্য বানানো হচ্ছে বেশ বড় স্টেইজ।
পদ্মা সেতু বাংলাদেশের পদ্মা নদীর উপর নির্মিত একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু। এর মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের সাথে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলা যুক্ত হয়। ২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে।
তথ্য সুত্র: উইকিপিডিয়া
আমরা পদ্মা সেতুর নিচ দিয়ে মাওয়ার দিকে এগুতে থাকলাম। পাশেই চোখে পড়ল প্রজেক্ট হিলসা। শুনেছি এখানে খাবারের মূল্য অনেক বেশি রাখা হয়।
ইলিশ খেতে মাওয়া
অবশেষে আমরা ইলিশ খেতে মাওয়া ফেরি ঘাট চলে আসলাম। আমরা গাড়ি নিয়ে একেবারে ঘাট এর কাছে চলে এসেছি। গাড়ি থেকে নামলাম। লোকজন এর ভিড় খুব একটা নেই। হয়তো বৃষ্টি হয়েছে তাই তেমন লোকজন আসে নি।
তবে শুনেছি সবচেয়ে লোক বেশি হয় রাতের দিকে। আমরা নেমে লঞ্চ ঘাটের পাশেই একটি ছোট মাছ বাজার রয়েছে সেখানে গেলাম ইলিশ মাছ কেনার জন্য। ছোট একটি বাজার। অথচ লোকের প্রচুর ভিড় রয়েছে এখানে। নদীর নানা প্রকারের মাছ কেনা-বেচা হচ্ছে এখানে। তবে বেশিরভাগ লোকদের দেখলাম ইলিশ মাছ কিনে নিয়ে যেতে। নদীর টাটকা মাছ পাওয়া যায় এখানে।
আমরা প্রথমে একটা ইলিশ মাছ নিলাম। ইলিশ মাছ এর ওজন হল: ১ কেজি ৭০০ গ্রাম এর মত। এখন প্রতি কেজি ইলিশ মাছ এর দাম ১৮০০ টাকা করে রাখছে। তবে সেটা মাছ এর ওজন এর উপর নির্ভর করে কম বেশি হচ্ছে।
আমরা মাছ নিয়ে ‘মাইশা হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট’ এ চলে আসলাম।
আরও: মুন্সিগঞ্জ জেলার দর্শনীয় স্থান সমূহ
ইলিশ মাছ খাওয়ার প্রক্রিয়া
মাওয়াতে আসলে কিভাবে ইলিশ মাছ খাওয়া হয় তার সুন্দর একটি প্রক্রিয়া রয়েছে।
- প্রথমে আপনি আপনার ইচ্ছেমত যে কোন স্থান (বাজার বা কিছু কিছু দোকানেও পাওয়া যায়) থেকে ইলিশ মাছ কিনে নিবেন।
- হোটেল/ রেস্টুরেন্ট নির্বাচন করবেন।
- রেস্টুরেন্ট এর কাছে আপনার কিনে আনা মাছ দিবেন। তারা তাদের লোক দিয়ে মাছ কেটে দিবে।
- রান্নার জন্য তারা আপনাকে পরিমান মত তেল কিনে দিবে বা আপনাকে কিনে দিতে বলবে। বেগুল নিবেন। সাথে আর যা যা প্রয়োজন।
- তারা আপনার ইলিশ মাছ ভেজে দিবে। ইলিশ মাছ এর লেজ ভর্তা করে দিবে।
- খাবার পরিবেশন করবে। সাথে ভাত, পানি, ডাল, কোমল পানিও ইত্যাদি দিবে।
ইলিশ মাছ খাওয়া
নাহিদ পরে আরও ১টি ইলিশ মাছ কিনে আনে। মাছ কাটা শেষে মাছ ভাজি, লেজ ভর্তা ও বেগুন ভাজি করা হয়।
এর মাঝে আমরা লঞ্চ ঘাটে গিয়ে কিছু ছবি তুলি।
সব শেষে আমরা খেতে বসলাম। ইলিশ মাছ ভাজার ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম। সবাই মজা করে পেট পুরে খেলাম।
ইলিশ মাছ ভাজার ভিডিও দেখুন
টাটকা মাছ এর স্বাদই আলাদা। ইলিশ লেজ ভর্তা টা দারুণ হয়েছে। বেগুন ভাজিও দারুণ লাগল।
খাওয়া শেষে কোক খেতে খেতে আমরা ঘাটের দিকে গেলাম। এখানে স্পিড বোড সন্ধ্যা ৬টায় বন্ধ হয়ে যায়। নদীর পাড়ের পরিবেশা দারুণ লাগল।
পরিশেষে আমরা মাওয়া ফেরি ঘাট থেকে বিদায় নিলাম। আসাধারন একদিনের একটি ভ্রমণ ছিল। আপনিও চলে আসতে পারেন বন্ধুদের নিয়ে বা পরিবার নিয়ে। আসাকরি আপনাদের সময়টা দারুণ কাটবে।
মাওয়া দর্শনীয় স্থান
মাওয়া দর্শনীয় স্থানে দেখার মত রয়েছে-
- মাওয়া ফেরি ঘাট
- মাওয়া লঞ্চ ঘাট
- স্পিড বোড এর ঘুরা
- পদ্মা সেতু দেখা
- পদ্মার পাড় ঘুরা
মাওয়া ভ্রমণ টিপস
মাওয়া ভ্রমণ নিয়ে ভ্রমণ টিপস গুলো দেখুন।
- ইলিশ মাছ খেতে মাওয়া আসলে সাথে অবশ্যই কাউকে নিয়ে আসবেন। একা একা এখানে ভালো লাগবে না।
- ইলিশ মাছ কেনার সময় দরদাম করে নিবেন।
- কয়েকটা রেস্টুরেন্ট ঘুরে দামাদামি করে নিন অথবা ঘাট থেকে মাছ কিনতে পারেন।
- দুপুরে করা রোদে আসলে তেমন একটা মজা পাবেন না। এজন্য বিকেলের দিকে আসতে পারেন।
- ইলিশের লেজ ভর্তা খেতে ভুলবেন না।
- রাতে গেলে অবশ্যই নিরাপত্তার বিষয়টা খেয়াল রাখবেন।
মাওয়া ঘাট যাওয়ার উপায়
গুলিস্তান বা যাত্রাবাড়ী থেকে মাওয়া ঘাট বাস যায়। ভাড়া নিবে আনুমানিক ৭০ টাকা, বিআরটিসি/ইলিশ পরিবহনে। মিরপুর ১০, ফার্মগেট এবং শাহবাগ থেকে যায় স্বাধীন পরিবহন। এসি বাসে যেতে চাইলে গুলিস্তান থেকে বিআরটিসি দিয়ে যেতে পারেন।
পদ্মার ঐপাড় যেতে পারেন লঞ্চ, ফেরি অথবা স্পীডবোট দিয়ে। ভাড়া নিবে ৩৫ কিংবা ২০/১৫০ টাকা। সময় লাগতে পারে ২ ঘন্টা, ১:৩০ ঘন্টা অথবা ৩০ মিনিট এর মত।
আরও: মায়াদ্বীপ ভ্রমণ
ভ্রমণ জিজ্ঞাসা
ঢাকা থেকে মাওয়া কত কিলোমিটার?
৫৭ কিলোমিটার প্রায় (সড়কপথ)
মাওয়া ঘাট যেতে ভাড়া কত নিবে?
গুলিস্তান বা যাত্রাবাড়ী থেকে মাওয়া ঘাট বাস যায়। ভাড়া নিবে আনুমানিক ৭০/- বি আরটিসি/ইলিশ পরিবহন। মিরপুর ১০, ফার্মগেট এবং শাহবাগ থেকে যায় স্বাধীন পরিবহন। এসি বাসে যেতে চাইলে গুলিস্তান থেকে বিআরটিসি দিয়ে যেতে পারেন।
গুলিস্তান থেকে মাওয়া কত কিলোমিটার?
৫৭ কিলোমিটার প্রায় (সড়কপথ)
ঢাকা থেকে পদ্মা সেতুর দূরত্ব কত?
৫৪ কিলোমিটার প্রায় (সড়কপথ)
মাওয়া ঘাট দর্শনীয় স্থান
মাওয়া ফেরি ঘাট, মাওয়া লঞ্চ ঘাট, স্পিড বোড এর ঘুরা, পদ্মা সেতু দেখা, পদ্মার পাড় ঘুরা।
একদিনে মাওয়া ভ্রমণ করা যাবে কি?
হ্যাঁ। মাওয়া ঘাট একদিনে ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত।
ফেসবুক: Kuhudak