আজকের ভ্রমণ গল্প পীর ও পার্বতীর পাহাড়ে (Pir o Parvatir Pahare)! সকালের পরীক্ষা উপেক্ষা করে, সন্ধ্যার পর পরিকল্পিত হল ধরণী পাহাড় আরোহণের রূপরেখা। নোটবুকে ফুটে উঠেছে রোড ম্যাপ, পাহাড়ের নকশা ও ছয় যাত্রী যথা আমাদের লম্বা লাইন। চিত্রকর সামিউল নেতৃত্বে আমানকে স্থান দিয়েছে। তার পিছনে পিছনে আমরা মরিবা হয়ে উঠবার চেষ্টা করছি সাড়ে তেরোশো ফুট উঁচু ধরণী পাহাড়।
দু’দিন পর আমাদের থার্ড সেমেস্টার পরীক্ষা শেষ হলে বৈকালেই ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে যায়। আমি আলী আহমেদের বাড়িতে রাত অতিবাহিত করলাম। মাসির সঙ্গে কথা বলতে খুব ভালো লাগলো। বুঝতেই পারিনি কখন রাত সাড়ে দশটা বেজে গেছে। সকাল সকাল সবাই একত্রিত হয়ে দুজন দুজন করে তিনটি বাইকে রওনা হলাম বর্ডার পার পাহাড়ের উদ্দেশ্যে।
আরও: ভ্রমণ কাহিনী
পীর ও পার্বতীর পাহাড়ে ভ্রমণ, ভারত
রাজগ্রাম রেল গেটে লম্বা জাম। আমি আনিকুলের গাড়ি থেকে নেমে এটিএমের সন্ধানে ফটক পারে এলাম। সে নৈরুলের অ্যাপাচি গাড়ি নিয়েছে। দেড় লিটার পেট্রোল গিলিয়েছি। দেখি এটিএমেও বেশ ভিড়। কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই রেল গেট লাইন পার করে চলে আসে। একটু অপেক্ষার পর পাঁচশো টাকা বের করলাম। দুশো টাকা সামিউলকে দিলাম। আলী আহমদের কাছ থেকে আসলে চারশো টাকা নিতে ভুলে গেছিলাম। তারপর দ্রুত টানে সন্তোষপুর, গোপালপুর সব অতিক্রম করে ঢুকে পরলাম পাহাড়ি অঞ্চল সাঁওতাল পরগনায়।
গুগল ম্যাপ দেখতে দেখেতে আমরা পাহাড় উপতক্যয় পৌছালাম। চারিদিকে উঁচু পাহাড়মালা যেন পহুরি স্বরুপ এই সুন্দর সবুজ ভরা জায়গাটিকে প্রতিরক্ষা করতে দাঁড়িয়েছে। তবুও দেখি লোভ লালসার মরিচা পরা মানুষের মন থামেনি। তারা কোন ফাঁকে ঢুকে পড়েছে এবং কয়লা সম্পদ কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার ধারে ধারে অনিচ্ছুক প্রতিবাদী কয়লা ধূলা দল বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে আছে। কোন বাহক পার হলেই তারা সামনে এসে বিক্ষোভ জানাচ্ছে। কিন্তু তাদের ক্ষ্যান্ত প্রতিবাদ কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার শান্ত হয়ে পড়ছে।
পার্বতীর পাহাড়ে
স্থানীয় অধিবাসীদের জিজ্ঞেস করতে করতে পাহাড় মুখে উপনীত হলাম। কিন্তু দাঁড়িয়ে ঘুরে দেখি আমাদের সঙ্গ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আমাদের হিসেব ছিল তিনটি মোবাইল যেন তিনটি বাইকে থাকে, যাতে কেউ এদিক ওদিক হলে যোগাগোগ করা যায়। তবুও সামিউল কিভাবে একা পরে গেছে এবং তার কাছে মোবাইলও নায়। সেও আবার আমাদের উনুসরণ না করে এদিক ওদিক গাড়ি দৌরিয়েছে। আমি নিজেকে না সামলাতে পেরে ছোট পাহাড়টির ওপর চেপে মন খুলে চেঁচিয়ে এলাম।
অনিকুলের খুব রাগ। সে বলে: আরে একজনের খোঁজ নেয়! আর তুই? সঙ্গে সঙ্গে আমান তার স্কুটি নিয়ে আবার পিছনে দৌরাল। এমন ভুলভুলায়াতে আমরা ফেঁসে পড়েছে যে আশেপাশে কোন বাজার বা দোকানও নেয়। বাইকে তেলের পরিমাণও কম। কিছুক্ষন পর দেখি সামিউল একা আসছে। এবার কিন্তু আমানের খোঁজ নিয়ে চিন্তা। অনেক্ষন হয়ে গেল সে আসেনা। তাকে ফোন লাগাবার চেষ্টা করলাম কিন্তু সবারই ফোন নেটওয়ার্ক কভারেজ এ্যারিয়ার বাইরে। কিছুক্ষন পর সেও একা একা এলো।
সিধু আর কানু দুজন তীরন্দাজ বালক তীর আর ধনুক নিয়ে আমাদের দেখে হাসছে। আমি চেষ্টা করলাম তাদের সঙ্গে নিজেকে হারিয়ে দিই। তাদের ভাষায় কথা বললাম। কানুর একটা গাল টিপে ধরলে সে দাঁত দেখিয়ে কি মাতানো হাসি ফিরিয়ে দিল! সিধুর তীর ধনুক নিয়ে আমিও খানিকটা দক্ষতা দেখালাম। ব্যাগে দুটো ক্যাটবেরি ছিল। একটাকে আধা আধি পকেটেই ভেঙে তাদের দিলাম। তারা পাশে গাছের ডালের ফাঁক দিয়ে আনন্দ বিস্ময়ের দৃষ্টিতে দেখতে লাগল। আমরা শিবু পাহাড়ির বাড়িতে গাড়ি রেখে আরম্ভ করলাম ধরণী পাহাড় আরোহণ।
প্রথমেই আমরা একটি টিউব ওয়েল দেখতে পেলাম। কে বলে উঠলো: ‘আরে, চল। একেবারে পাহাড় শৃঙ্গে উঠে মন্দিরে জল পান করবো।’ আনিকুল এবং মুবারক আগে আগে সুড়সুড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সব থেকে পিছনে আমান এবং তার আগে আমি। মাঝে দুই মোটু শেরু আর সামিউল। জাগায় জাগায় পাথুরে আসনে বিভিন্ন ভঙ্গিতে বসে, দাঁড়িয়ে ফোটো তুলছি – কখনও দলীয় চিত্র, কখনও একক আবার কোনো সময় আত্মচিত্র। আর আমান ফোটোগ্রাফার।
কিছুক্ষণের মধ্যে আমান আর আমি শার্ট খুলে ফেলেছি। কেউ তো আবার চার পায়ে হাঁটছে। দু’পা এগিয়ে তিনের বেলায় আর পা উঠাতে পারছিনা। মনে হচ্ছে এখানেই আরোহণ ক্রিয়া সমাপ্ত করে অবরহণ যাত্রা আরম্ভ করি। কিছুই সরঞ্জাম আমাদের কাছে নেয়। এমনকি একটা জলের বোতলও সঙ্গে নিয়ে আসিনি। কোনো ফলের সন্ধানে গাছ গাছালির মধ্যে দিয়ে চিলের দৃষ্টি নিয়ে গিয়ে আবার ব্যার্থ হয়ে ফিরে আসতে হচ্ছে। এদিক হয়েই বাড়ি ফিরবো, তাই বিক্রম-বেতালের মত পিঠে ব্যাগের বোঝোও পথ ছাড়েনা।
আরও: ঈশ্বর রাজ্য কেরল থেকে বাংলার বাড়ি প্রত্যাগমন (ভারত)
শিব মন্দির
সবাই এক প্রস্থ কোন দেখে ঠাঁই নিয়ে বসে আছি, হঠাৎ মোবারক চিৎকার করে উঠল: ‘চলে এসেছি! ওই মন্দির। পিপাসা শেষ।’ একটু উৎসাহ ও প্রগতির সাঁথে এগিয়ে গেলাম। প্রথমেই দেখতে পেলাম সাদা পেলেট বসানো শিব মন্দির। আসে পাশে পার্কে থাকা ছোটো ছোটো সুন্দর্যের গাছ। উদ্যোক্তারা ভালোই বন্দোবস্ত নিয়েছে জায়গাটিকে আকর্ষক করার প্রচেষ্টায়। এসব কিছুই ধরণী বাবা গোপাল পাহাড়ি ও তার ঘরবালির উদ্যোগে হয়েছে।
আরও: রাত ২টা ৫২ মিনিট!
তারা আগামী শিবরাত্রির পর নিচে থেকে ওপর অবদি সিড়ি তোলার পরিকল্পনাও করেছে। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ, পানীয় জলেরও ব্যবস্থা হবে। তাদের কুটির ঘর পিপাসায় ক্লান্ত আরোহীদের জন্য জলের বোতলে অর্ধেক ভর্তি। একটা পাটের রসি দিয়ে তৈরি খাটও আছে। বেলা ডুবায় কোনো আরোহী হাজির হলে, সে যখন নিচে নামতে পারে না তখন তাদের এখানেই রাত অতিবাহিত করতে হয়। তাছাড়া তাদের বছরের প্রত্যেকদিন সকাল সন্ধ্যা আরোহণ-অবরহন হয়। ধরণী মা বললেন: ‘আমরা পাহাড়ী। আমাদের অভ্যেস বাবা।’ দেখে অবাক হলাম তাদের গৃহপালিত গায় গুরুও পাহাড়ের শেষ মাথায় উঠে বিচারণ করছে।
আমরা যখন যায় তখন বাবা পরিবার আর একটা কুটির নির্মাণের কাজে ছিলেন। সেটা নাকি জল পানির দোকান হবে। আগেই বলা ভালো, সেখানে অর্ধেক লিটার জলের মূল্য ত্রিশ টাকা। আর একটা বিস্ময়ের কথা যে তাদের কুটির ছাদ ঢালাই বালেস্টারের। কিভাবে উঠিয়েছেন জিজ্ঞেস করলে ধরণী বাবা বড়ো নিশ্বাস নিয়ে বললেন: ‘শিব শক্তি।’ আমাদের থাকতে থাকতেই আরও দুটি আরোহীর দল তাদের গন্তব্যস্থলে উপনীত হয়।
ধরণী বাবা যেখানে তার দুই সঙ্গীকে নিয়ে নতুন দোকানের জন্য কাঠ কাটছে সেখানে আমরাও গিয়ে বসলাম। আমান আর সামিউল হাত পা ছেরে দিয়ে খাটের উপর তাদের অচল শরীরকে ছেরে দিয়েছে। আমি, শেরু ও মুবারক পুরো মন্দির চত্বরের চক্কর লাগালাম। নবারোহিদের সঙ্গে কথাও বললাম। একটা ব্লগ ভিডিও তৈরি করে ফিরবার সিদ্ধান্ত নিই। খুব তাড়াতাড়ি এক টানেই নেমে পরি।
আরও: সুন্দরবনে হারিয়ে যাওয়া ৬ কিশোরের শ্বাসরুদ্ধকর ভ্রমণ কাহিনী
সর্ব প্রথম জোহরের নামাজ আদায় করলাম। তারপর প্রধান রোড ধরে বেরিয়ে পরলাম কোনো হোটেলের সন্ধানে। ওই আদিবাসীর রাস্তায় হোটেল তো পেলাম না, তাই একটা চায়ের দোকানে মসলা মুড়ি খেয়েই সেদিনকার মধ্যন্নাহার সারলাম। তারপর চকচকে ফাঁকা সাহেবগঞ্জ-দুমকা রোড ধরে পীর পাহাড়ের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
পীর পাহাড়
জিজ্ঞেস করতে করতে আমরা পৌছালাম পীর পাহাড়ে। এক সাইন বোর্ডে মহেশপুরের দূরত্ব ১২ কিলোমিটার দেখে মুরারই পথ দিয়ে বাড়ি ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। পীর পাহাড়ে পৌছাতেই দেখি বড়ো এক ভোজের আয়োজন – কারও মানত আছে। আমাদেরও খাবার জন্য তারা ডাকছিল, কিন্তু সময় দিতে পারিনি। সম্ভবত ১২৮ ধাপ সিড়ি পেরিয়ে আমরা পৌঁছলাম হযরত পীর সৈয়দ শাহ আব্দুর রহিম (র:)-এর মাজারে।
গোলাকারে বসে আমরা তাঁর ওয়াসিলায় দুয়া করলাম। খাদেম সাহেবকে হযরত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন: ‘হুজুরের কৃতিত্ব বলে শেষ করা যাবেনা। তোমরা যে কামনায় এসেছো, তা পেয়ে যাবে।’ আমরা তোষামোদ করেও তার কাছ থেকে কিছুই জানতে পারলাম না। এখান থেকে আমি আমানের স্কুটি ড্রাইভিং শুরু করি। আর ভাগ্যক্রমে মহেশপুর-মুরারই রোডে পেয়ে গেলাম বাইক শিখবার সাজা!
ভ্রমণ কাহিনী পীর ও পার্বতীর পাহাড়ে লিখেছেন: Md Sohel Mondal (ভারত)
ফেসবুক: Kuhudak
বানান ভুল। যতি চিহ্নের সঠিক ব্যবহার নেই। ভালো করে স্ক্রুটিনি করে তবে আপলোড করুন।
আপনাকে ধন্যবাদ। পোস্ট এর কোথাও ভুল বা অসংগতি থাকলে আমরা যাচাই করে উপডেট করে দিব।