মায়াদ্বীপ ভ্রমণ – নুনেরটেক, সোনারগাঁ, নারায়ণগঞ্জ। মেঘনা নদীর বুকে ভেসে ওঠা একটি চর বা দ্বীপ যা, নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁ উপজেলার বারদী ইউনিয়নের নুনেরটেক গ্রামে অবস্থিত।
অল্প কিছু সময় ভ্রমণের জন্য নারায়ণগঞ্জ জেলার মায়াদ্বীপ বা নুনেরটেক দর্শনীয় স্থানটি হতে পারে ভ্রমনপ্রেমীদের জন্য আদর্শ জায়গা।
তাই আজকের ভ্রমণে আমি আপনাকে নিয়ে যাব শত বছর আগে মেঘনার বুকে জেগে উঠা মায়াদ্বীপে।
চলুন শুরু করা যাক…
আরও: পানাম নগর
মায়াদ্বীপ ভ্রমণ
ভ্রমণ স্থান | মায়াদ্বীপ (Maya Dwip) |
অবস্থান | নুনেরটেক, সোনারগাঁ, নারায়ণগঞ্জ |
নদী | মেঘনা নদী |
যাতায়াত ব্যবস্থা | ট্রলার বা নৌকা |
ভাড়া | ২০০-৩০০ টাকা (ঘন্টা) |
ড্রোন | উড়ানো যাবে |
ঢাকা থেকে দূরত্ব | ৩৯.২ কিলোমিটার (প্রায়) |
মায়াদ্বীপ ভ্রমণ প্রস্তুতি
মায়াদ্বীপ ভ্রমণের জন্য আমরা গোয়ালদি মসজিদ থেকে অটোরিক্সা করে যাত্রা শুরু করলাম। আপনার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে, আমরা ঢাকা থেকে ভ্রমণে এসেছি। উদ্দেশ্য একদিনে নারায়ণগঞ্জের ৩টি দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করা।
ভ্রমণের শুরুতে আমরা প্রথমে পানাম নগর তারপর গোয়ালদি মসজিদ ভ্রমণ করেছি। আর এখন যাচ্ছি মায়াদ্বীপ।
দুপুরে লাঞ্চ শেষ করে আমরা গোয়ালদি মসজিদ ভ্রমণে যাই। গোয়ালদি মসজিদ থেকে অটোরিক্সায় ১০০ টাকা ভাড়া দিয়ে সরাসরি চলে আসলাম মেঘনা নদীর পাড় বা, বারদী বৈদ্যের বাজার ঘাটে।
বারদী বৈদ্যের বাজার
বারদী বৈদ্যের বাজার খুব বেশি বড় না আবার খুব ছোটও না। অটোরিক্সা থেকে নেমেই চোখে পড়ল বিশাল এক নদীর যার নাম মেঘনা নদী।
মেঘনা নদীর পাড়েই বারদী বৈদ্যের বাজার। আর ঐ পাশে মায়াদ্বীপ বা নুনেরটেক। নুনেরটেক এর ইতিহাস নিয়ে একটু পড়েই বিস্তারিত ভাবে বলব।
আমরা যখন বারদী বৈদ্যের বাজার গিয়ে পৌঁছেছি ঘড়িতে তখন সময় বিকাল ৩:১০ মিনিট। নদীর পাড়ের এই বাজারে মিলেছে মাছের বাজার। রুই, বাঘাইড়, রিঠা মাছ সহ সামুদ্রিক অনেক প্রজাতির মাছের দেখা পেলাম।
এই বাজারে আপনি পান-সুপারি থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় সামগ্রী পেয়ে যাবেন। তবে নদী ভ্রমণের পূর্বে অবশ্যই সাথে খাবার পানি নিয়ে নিবেন।
আরও: গোয়ালদি মসজিদ
মায়াদ্বীপ এর ইতিহাস
মেঘনা নদীর পাড়ে ভেসে উঠা ছোট্ট এই দ্বীপের ইতিহাস জানব ছোট্ট করেই। নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁয়ে ঐতিহ্যবাহী বারদী ইউনিয়নের অন্তর্গত নুনেরটেক নামে একটি গ্রাম রয়েছে। আজ থেকে প্রায় শত বছর পূর্বে মেঘনার বুকে ভেসে উঠা এই চরটির নাম স্থানীয়রাই রেখেছিল নুনেরটেক।
নুনেরটেক নাম রাখার সঠিক কারন জানা না গেলেও এই টুকু ধারনা করা হয় যে, নদীর পানিতে লবন থাকায় এর এই নামকরন করা হয়েছিল। তবে, বর্তমানে নদীর পানি লবণাক্ত নয়।
বারদী ইউনিয়নের অন্তর্গত নুনেরটেক নামে এই গ্রামটি নারায়ণগঞ্জের মূল ভূ-খণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। নদীপথে মুল ভূখণ্ড থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৪ থেকে ৫ কিলোমিটারের মত।
আরও: তাজমহল সোনারগাঁও
দ্বীপ রহস্য
নুনেরটেকের কোল ঘেঁষে আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে আরও একটি চর জেগে উঠেছে। যার ৩টি অংশ রয়েছে। এই ৩ অংশের ৩টি নাম হল: গুচ্ছগ্রাম, সবুজবাগ এবং রঘুনার চর।
আর মজার বিষয় হচ্ছে, এই গুচ্ছ গ্রামের সামনে বিশাল অংশই হল বর্তমানের মায়াদ্বীপ।
বর্ষায় সময় এর অস্তিত্ব পানির তলদেশে থাকলেও শুকনো মৌসুমে বিরাট অঞ্চল নিয়ে তা দৃশ্যমান হয়। এই চরে দাঁড়িয়ে এক পাশে গ্রাম আর অন্য চারদিকে মেঘনায় নৌকায় মাছ ধরার দৃশ্য দেখতে চমৎকার লাগবে আপনার।
মায়াদ্বীপ ভ্রমণ
অটোরিক্সা থেকে বারদী বৈদ্যের বাজার নামার সাথে সাথেই বেশ কয়েকজন নৌকো এবং ট্রলারের মাঝি আমাদের ঘিরে ধরলেন। সবার মুখে একই কথা “মায়াদ্বীপ যাইবেন না, আহেন আমার সাথে”!
মায়াদ্বীপ যাওয়ার জন্য আপনাকে এখান থেকে নৌকো অথবা ট্রলার ভাড়া করতে হবে। ট্রলার ভাড়া করার সময় অবশ্যই দরদাম করে নিবেন। এখনে আপনি ঘন্টা চুক্তিতে বা, দিন চুক্তিতে ট্রলার ভাড়া নিতে পারবেন।
এছাড়া আপনি যদি একা হন তাহলে লোকাল মানে, অন্যদের সাথে ভাড়া শেয়ার করে ভ্রমণে যেতে পারবেন।
তবে আমি বলব এই দ্বীপে ঘন্টা চুক্তিতে ট্রলার ভাড়া করাই শ্রেয়। কারন এখানে সারাদিন থেকে দেখার মত কিছু নেই। কিন্তু, পিকনিক বা শিক্ষা সফর হলে ভিন্ন কথা।
আমরা একটা ট্রলার ভাড়া করলাম। যিনি আমাদেরকে ৪০০ টাকার বিনিময়ে ২ ঘন্টা ঘুরাবেন। তবে এর ভিতরে যেতে আর আসতে সময় লেগে যাবে প্রায় ৪০ মিনিট এর মত।
যাওয়ার সময় সাথে করে শুঁকন খাবার এবং খাওয়ার পানি নিয়ে নিলাম।
ট্রলারের ইঞ্জিন স্টার্ট হল। আমরা ব্যাকপ্যাক ট্রলারের ভিতরে রেখে ট্রলারের ছাউনির উপরে উঠে বসলাম। ট্রলার এগিয়ে চলছে… গায়ের সাথে বাতাসের ধাক্কার গতি ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল। আমরা এগিয়ে চললাম দ্বীপের দিকে।
ট্রলারের মাঝি ছাড়া আমরা সবাই এই প্রথম এই দ্বীপে যাচ্ছি। তাই আনন্দটা অন্যরকম।
দুই পাশে বিশাল নদী। মাঝখান দিয়ে আমাদের ট্রলার এগিয়ে চলছে।
নুনেরটেক দ্বীপ
প্রায় ২০ মিনিট পর আমরা নুনেরটেক দ্বীপে এসে পৌছালাম। দ্বীপে পৌছে আমরা আরও কয়েকটি ট্রলার ও নৌকো দেখতে পেলাম।
দ্বীপটি খুব বড় না কিন্তু। যেমনটি আমরা দেখেছিলাম পদ্মার পাড়ে জেগে উঠা মিনি কক্সবাজার চাঁদপুর ভ্রমণে। এই দ্বীপটি তার চেয়ে অনেক ছোট।
এই দ্বীপটি সবুজ ঘাসে ঢাকা। সেই সবুজ ঘাসের উপর কিছু ছেলেকে ফুটবল খেলতে দেখলাম। কেউ কেউ নৌকোর পাশে দাড়িয়ে ছবি তুলছে। আবার কয়কজন দলবদ্ধভাবে হেটে বেড়াচ্ছে, অনেকে আবার নদীতে নেমে হৈ-হুল্লোড় করে গোসল করছে।
সম্পূর্ণ দ্বীপটিতে বালু ছাড়া অন্য মাটির দেখা পাবেন খুব কম। দ্বীপের একপাশে একটি গ্রাম রয়েছে। অন্য পাশে বিশাল নদী।
নদিতে জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য দেখতে পেলাম। আমরা প্রায় ঘন্টা খানিক থাকার পর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
দ্বীপ ভ্রমণ টিপস
মায়াদ্বীপ ভ্রমণে কিছু টিপস দেয়া হল:
- ট্রলার ভাড়া করার সময় অবশ্যই দরদাম করে নিবেন।
- সাথে অবশ্যই শুকনো খাবার এবং খাবার পানি নিয়ে নিবেন।
- চাইলে আপনি মেঘনা নদীতে গোসল করতে পারেন তাই সাথে অবশ্যই গোসলের জন্য জামাকাপড় নিয়ে নিবেন।
- নদীর পানি পান করবেন না।
- নৌকায় ব্যাগ রেখে ঘুরতে যাওয়ার সময় অবশ্যই সতর্ক থাকুন। প্রয়োজনে মূল্যবান জিনিসপত্র সাথে বহন করুন।
- সন্ধ্যার পর এখানে ভ্রমণ করবেন না বা এখানে থাকবেন না।
- পানিতে ছবি তোলার সময় মোবাইল অথবা ক্যামেরা সাবধানে ব্যবহার করুন।
- অন্যের দেয়া কোন খাবার খাবেন না।
- প্রচন্ড ঢেউ এর সময় নৌকা অথবা ট্রলারের ভিতরে অবস্থান করুন।
- বৃষ্টির দিনে অবশ্যই সাথে করে রেইনকোট বা ছাতা নিয়ে নিবেন।
- নদীর পানিতে প্রস্রাব করবেন না।
- প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট করবেন না।
- ট্রলারের ছাউনিতে বসার সময় সতর্ক থাকুন।
মায়াদ্বীপ ভ্রমণ গাইড
ঢাকা থেকে দ্বীপ এর দূরত্ব প্রায় ৩৯.২ কিলোমিটার। পানাম নগর থেকে দূরত্ব প্রায় ৩.৫ কিলোমিটার।
ঢাকা থেকে বাস ভ্রমণ
আপনাকে ঢাকা গুলিস্তান থেকে স্বদেশ, বোরাক, দোয়েল ও সোনারগাঁ নামক বাসে উঠে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সোনারগাঁ মোগরাপাড়া চৌরাস্তায় নামতে হবে।
- স্বদেশ পরিবহণ
- বোরাক পরিবহণ
- দোয়েল পরিবহণ
- সোনারগাঁ পরিবহণ
বাস টিকিট মূল্য: গুলিস্তান থেকে ৪০ হতে ৫০ টাকা (এসি/নন-এসি)।
মোগরাপাড়া থেকে সরাসরি অটোরিক্সা করে বারদী বৈদ্যের বাজারে চলে আসবেন। চাইলে রিক্সা অথবা সিএনজিতে করে যেতে পারেন। এছাড়া নিজস্ব পরিবহণ থাকলে সেটা দিয়েও যেতে পারেন। কারন যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো।
ভাড়া: মোগরাপাড়া থেকে অটোরিক্সা ভাড়া নিবে জন প্রতি ১৫ টাকা।
আরও: বাংলাদেশের ৬৪ জেলার দর্শনীয় স্থান
উপসংহার
সবশেষে বলব যে, দ্বীপটি ছেড়ে আসতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল এখানেই থেকে যাই। মায়াদ্বীপ এর নামকরণ কেন হয়েছে সেটা মনে হয় এখন বুঝতে পারলাম। কারন, এই দ্বীপে আসলে আপনি এই দ্বীপের মায়ায় পড়ে যাবেন।
ফেসবুক: Kuhudak
খুব ভাল।চমৎকার
ধন্যবাদ